
সাঈদ বিন তারিক:
গত একুশে আগস্ট অনেকটা নীরবে নিভৃতে বিশ্ব রাজনীতি বড় এক ধরনের ধাক্কা খেল। সেদিন রুশ দার্শনিক আলেকজান্ডার দাগিনের মেয়ে দারিয়া দাগিনা মস্কোর রাস্তায় গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন। আপাত:দৃষ্টিতে ঘটনাটিকে ছোট মনে হলেও এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। আলেকজান্ডার দাগিনকে বলা হয়ে থাকে পুতিনের ‘মস্তিষ্ক’ বা ‘আধ্যাত্মিক গুরু’। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পরবর্তীতে কী সিদ্ধান্ত নিবেন- তার অনেকটাই জায়গা দখল করে রাখে দাগিনের দর্শন।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এখন অনেকটাই টালমাটাল। উন্নত দেশগুলো ক্রমাগত অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হচ্ছে। এর প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর পেছনে অনেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যেভাবে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মক ধ্বসের শিকার হয়েছে তাতে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এই ধ্বস কাটিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ অর্থনীতিতে কিছুটা গতি সঞ্চার হয়েছে। যেই জ্বালানী তেলের দাম বিশ্ব বাজারে ব্যারেল প্রতি ১১২ ডলারে পৌঁছেছিল তা এখন ৯০ ডলারের নিচে নেমেছে। অপরদিকে ইউক্রেনে যেসব খাদ্যশস্য আটকে ছিল বহু দেন-দরবারের পর রাশিয়া তা ছাড়তে সম্মত হয়েছিল। এছাড়াও কৃষ্ণসাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলেও রাশিয়ার পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার কথা হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট অচীরেই কেটে যাবে বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি আমাদের দেশের কয়েকজন মন্ত্রীও বক্তব্য দেন, এই সঙ্কট আর একমাস থাকবে।
তুরষ্ক-ইরানের মত রাশিয়ার মিত্র দেশগুলোর মাধ্যমে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে আলাপ অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল। দাগিন কন্যার হত্যার পর এই আলাপ অনেক পিছিয়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। আর দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। উন্নয়নশীল যেসব রাষ্ট্র আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মত দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে- তাদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এর উপর পুতিন যেসব বিষয়ে ছাড় দিচ্ছিল অর্থাৎ ইউক্রেনে উৎপাদিত পন্য রপ্তানী, কৃষ্ণসাগরে জাহাজ চলাচল- এসব বিষয়ে পুতিন আরো কঠিন হলে জ্বালানী তেলের দাম আবারো ঊর্ধ্বমুখী হবে। সেইসাথে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম।
ইতোমধ্যে দারিয়া দাগিনা হত্যার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছে রাশিয়া। এ হত্যাকাণ্ডকে ‘জঘন্য’ ও ‘নির্মম’ অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন পুতিন। পুতিন বলেছেন, ‘ইউক্রেনের এজেন্টরাই দারিয়াকে হত্যা করেছে এবং তাদের মূল লক্ষ্য ছিল তার বাবা আলেকজান্দার দাগিন।’ ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। পুতিন দারিয়া দাগিনা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে ইউক্রেনে হামলার গতি আরো বাড়াতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে ইউক্রেনের স্বাধীনতা দিবস এবং সেখানে রুশ আগ্রাসনের ছয় মাস পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে রাশিয়া ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের বেসামরিক অবকাঠামো ও সরকারি ভবনগুলোতে তীব্র হামলা চালাতে পারে আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন নাগরিকদের ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। রাশিয়া হামলার তীব্রতা বাড়াতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে ইউক্রেন সরকার রাজধানী কিয়েভে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সব ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠান আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রুশ বাহিনী দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব জেপোরোজিয়া অঞ্চলে গোলা এবং বিমান হামলা চালিয়েছে। সেখানে ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে তুমুল লড়াই হয়েছে। ছয় মাসের এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। নগরীগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে এবং এ যুদ্ধ এখন একটি অচলাবস্থার মধ্যে আটকে গেছে। রুশ বাহিনী কৃষ্ণ সাগর উপকূলসহ ইউক্রেইনের দক্ষিণের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। পূর্বের ডনবাস অঞ্চলের অনেকাংশও এখন তাদের দখলে। যুদ্ধ বন্ধের কোনও সম্ভাবনা এখন আর প্রায় নেই বললেই চলে, বরং পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।