
জাফর আহমদ
শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হলেও তা কখনো কখনো জাতির মাথার উপর অসহনীয় বোঝা হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। পৃথিবীতে প্রায় ২৫০টি ছোটবড় দেশের সকল মানুষের জন্য শিক্ষা মৌলিক অধিকার হলেও, সকল দেশের শিক্ষার চাহিদা এক রকম নয়। কিউবার ডাক্তার ও নার্সের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। জার্মানি তার অর্জিত উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য তাদের শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার উপযোগী কারিগরি শিক্ষা।
কারিকুলাম, সিলেবাস এবং পাঠ্যবই শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও একমাত্র বিষয় নয়। কতগুলো ব্যবস্থা (system) বা উপাদান মিলে সমগ্র শিক্ষার অবয়ব দাঁড়ায়। দেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করার পর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য পৃথক পৃথক লক্ষ্য নির্ধারণ করা আবশ্যকীয়। শিক্ষার আদর্শ বা নৈতিকতার ভিত্তি না থাকেেল তা পরগাছার মতো শক্তিহীন অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে। শিক্ষার
শিক্ষার সবচেয়ে বড় উপাদান হলো রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণের আদর্শ, বিশ্বাস ও চাহিদার মেলবন্ধন শিক্ষাকে জনবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিণত করতে পারে। উপর থেকে ছাপিয়ে দেয়া দেশের উন্নয়ন ও আদর্শবিরোধী যেকোন ব্যবস্থা জনকল্যাণকে ব্যাহত করে। তখন জনগণ সেই ব্যবস্থাকে নিজস্ব হিসেবে গ্রহণ করে না।
সাথে জাতীয় আদর্শ, বিশ্বাস ও মূল সংস্কৃতিকে অবশ্যই অঙ্গীভূত করতে হবে। জাতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ মহামানবদের motive বা চিত্র বিভিন্নভাবে ছাত্রদের মানসপটে এঁকে দিতে পারলে- তারা হবে নৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, আদর্শিকভাবে উজ্জীবিত এবং জাতির জন্য যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে নিবেদিতপ্রাণ কাণ্ডারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র Ralph Waldo Emerson (১৮০৩-৮২), তাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে (১৭৩২-৯৯) জাতির সামনে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বেছে নিয়েছে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের criteria এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ- একটি নিরন্তর মজবুত এবং sustainable শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে নীরবে নিভৃতে কাজ করে যায়। স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) এমন এক সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন, যার ধারাবাহিকতায় সারা পৃথিবীতে আইটি সেক্টরসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতীয়রা শক্তিশালী অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
জাতি গঠন (Nation building) এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। ধনী-দরিদ্র, মালিক-শ্রমিক, সমতলবাসী-পাহাড়ি উপজাতি এবং বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সামাজিক সংঘাতকে সৌহার্দ্যরে পথে নিয়ে এসে শক্তিশালী জাতি গঠন করতে হবে। এবং এই জাতি গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান সিলেবাসে এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে জুড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে উন্নয়নের এ পর্যায়ে প্রযুক্তি জ্ঞানহীন কেরাণী তৈরির শিক্ষায় ঘুরপাক খেয়ে জাতিকে লক্ষ লক্ষ বেকার উপহার দেয়া কতোটুকু বাস্তবসম্মত তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। জেনারেল এডুকেশনের গোলকধাঁধার শিক্ষাব্যবস্থা ইতোমধ্যে জাতির কাঁধে অভিশাপ হয়ে চেপে বসেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য প্রতি উপজেলায় একটি/দুটি করে নয়, ৮০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে পলিটেকনিক বিদ্যালয় বা কলেজে রূপান্তর করা অতীব জরুরী। এসব পলিটেকনিকে ৪ বছরের ডিপ্লোমা ডিগ্রিসহ ৬, ১২ ও ২৪ মাসের সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা দরকার। কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন এসব যুবক দুইভাবে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে এদেরকে আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি কারখানার ক্রমবর্ধমান মানবসম্পদের চাহিদা পূরণ করা যাবে।
জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার গুরুত্বের বিষয়টি শিক্ষাব্যবস্থায় উপেক্ষিত থাকতে পাারে না। বর্তমানে সামরিক বাহিনীর অফিসার পদে প্রয়োজনীয় জনবল তৈরির জন্য ১২টি ক্যাডেট কলেজের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া কিছু কলেজে BNCC (Bangladesh National Cadet Core) দেশের ৯৯ শতাংশ স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় প্রতিরক্ষা ভাবনা অনুপস্থিত। নিয়মিত বাহিনীর উপর নির্ভর করে টেকসই জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না। এরজন্য প্রয়োজন নিয়মিত সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে গনফৌজ (Peoples army)। মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় একজন করে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত চৌকস সদস্যদের নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে শরীর চর্চা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার Mental therapy দেয়া দরকার। যে সকল উপজেলায় সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনীর সেনানিবাস বা ঘাঁটি রয়েছে, সেসব উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার গুনগত মান মনিটরিং এর দায়িত্ব দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দেয়া দরকার। আমাদের মুখ থুবরে পড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে বাঁচানোর এটা একটা কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।
শিক্ষার সবচেয়ে বড় উপাদান হলো রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণের আদর্শ, বিশ্বাস ও চাহিদার মেলবন্ধন শিক্ষাকে জনবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিণত করতে পারে। উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া দেশের উন্নয়ন ও আদর্শবিরোধী যেকোন ব্যবস্থা জনকল্যাণকে ব্যাহত করে। তখন জনগণ সেই ব্যবস্থাকে নিজস্ব হিসেবে গ্রহণ করে না।
শিক্ষা এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। বিনিয়োগের দুয়েক বছর পর রাস্তাঘাট দেখা যায়, কিন্তু শিক্ষায় বিনিয়োগের ফল আসে কয়েক বছর পর। তবে শিক্ষা খাতের এ বিনিয়োগ দেশের উৎপাদন, অবকাঠামো খাতকে মহিমান্বিত বা গৌরব দান করে। সৎ, যোগ্য, দক্ষ, মিতব্যয়ী এবং দেশ ও জাতির উন্নয়ন, মর্যাদা-ভাবমূর্তি বিনির্মাণে অংগীকারাবদ্ধ মানবসম্পদ জাতিকে ক্রমাগত উপহার দেয়। ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা একজন প্রকৌশলী এক কোটি টাকা দিয়ে যে রাস্তা তৈরি করবে- তা টিকবে তিন বছর। অন্যদিকে একটি আদর্শিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা সৎ ও দক্ষ প্রকৌশলী একই রাস্তা আরো কম টাকায় নির্মাণ করবে এবং রাস্তাটি টিকে থাকবে তিন বছরের পরিবর্তে ত্রিশ বছর।
শিক্ষার জন্য গালভরা বুলি বা মায়া কান্না একটি কার্যকর ও টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা ও পরিচালনার জন্য হিতকর নয়। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলসহ সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য গড়ে তোলা যেমন দরকার, তেমনি দরকার প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ।
লেখক: সাবেক সচিব এবং শিক্ষাবিদ ও গবেষক।