
হোমিওপ্যাথিতে দর্শনের (Philosophy) অপরিহার্যতা বোঝার আগে আমাদের বুঝতে হবে দর্শন কি? দর্শন বা ফিলোসফি (Philosophy) শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ চযরষড়ং এবং ঝড়ঢ়যরধ হতে- যার অর্থ জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা। এর সাধারণ অর্থ জ্ঞানের অন্বেষণ। আসলে দর্শনের সর্বজনবিদিত কোন সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন দার্শনিক দর্শনকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
‘জ্ঞানানুরাগ ও জ্ঞানানুসন্ধানের নামই দর্শন’ (Philosophy is the love of wisdom of pursuit of knowledge)।:দার্শনিক সক্রেটিস
‘অন্তরের জ্ঞান লাভ করা ও বস্তুর বিশেষ প্রকৃতি অবগত হওয়াকে দর্শন বলে’ ((Philosophy aims at a knowledge of the internal of essential nature of things)।: দার্শনিক প্লেটো
‘দর্শন হলো বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ও জ্ঞানের সমালোচনা’ (Philosophy is the science and criticism of cognition)।:দার্শনিক কান্টে
মানুষের জানার ইচ্ছা নিরন্তর। সবকিছুতেই মানুষ জানতে চায় কি-কেন-কিভাবে? ইত্যাদি। জানার এই অসীম আগ্রহ থেকেই দর্শনের উৎপত্তি। দর্শন মানে হচ্ছে- দেখা। কি দিয়ে দেখা? শুধু চর্মচক্ষু দিয়ে নয়- অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখা। কারণ আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই পঞ্চইন্দ্রিয় তৃতীয় মাত্রায় (Third Dimensional) সীমাবদ্ধ। একই সাথে এই জগৎ হচ্ছে বহুমাত্রিক (Multi-Dimensional)- তাই এই জগতের বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য আমাদের দর্শনের সাহায্য নিতে হয়। এই দেখা একেক জনের একেক রকম হতে পারে, কারণ একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি (Aspect) একেক রকম। কিন্তু যেকোন ঘটনার মূল কারণ বা সত্য একটিই হয়ে থাকে। সেই সত্য উদঘাটন করা বা জানাই হচ্ছে মূলত দর্শন। যেমন অন্ধকারে কেউ একটি দড়ি দেখে সাপ মনে করে দৌড়ে পালাতে পারে কিন্তু সেটাতো আসলে সাপ নয়- সেটা হচ্ছে দড়ি।
আমাদের এই জগতে যে কোন ঘটনাই ঘটুক না কেন- তার একটা কারণ থাকে। এই কারণকে সবসময়ই আমরা প্রথম চিন্তাতেই দেখতে পারবো- ব্যাপারটা এরকম নয়। সেই কারণটাকে জানা বা উপলব্ধি (Realization) করাই হচ্ছে দর্শন। যেমন- শক্তি দেখা যায় না কিন্তু শক্তি দ্বারা ঘটিত কাজ দেখে আমাদের উপলব্ধি করে নিতে হয়- শক্তি আছে। মূলত যেখানে এই তথাকথিত বস্তুবাদী বিজ্ঞানের (Science) শেষ- সেখান থেকেই দর্শনের শুরু। আমরা জানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা অর্জিত সুসংবদ্ধ জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হয়। কিন্তু বর্তমানের এই বস্তুবাদী (Materialistic) বিজ্ঞান অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম- যদিও তারা তা স্বীকার করতে নারাজ। যেমন জীবন (Vital force) কি? এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা নেই। বলা হয়ে থাকে, কোষের ভিতরের প্রটোপ্লাজমের সক্রিয়তাই জীবন কিন্তু যদি বলা হয়- এই প্রটোপ্লাজম (Protoplasm) কেন সক্রিয় থাকে- তার কোন ব্যাখ্যা এই বিজ্ঞানের কাছে নেই।
আবার একজন জীবিত ও মৃত মানুষের মধ্যে কি পার্থক্যের জন্য একজন জীবিত মানুষের দেহে ঔষধ কাজ করতে পারে আর মৃত মানুষের দেহে ঔষধ কোন কাজ করতে পারে না? যদিও নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত জীবিত ও মৃত দেহের মধ্যে বস্তুগত কোন পার্থক্য থাকে না। তাহলে কি ‘একটা কিছু’র উপস্থিতির জন্য এই ঘটনাটা ঘটছে? এই ‘একটা কিছু’ জিনিসটা কি- তার উত্তর বর্তমানের এই বস্তুবাদী বিজ্ঞানের কাছে নেই।
বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরির্বতনশীল। আজ যেটাকে তারা সঠিক বলছে- কাল তা আবার ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। আসলে বিজ্ঞান মূলত করছেটা কি? তারা আমাদের এই তৃতীয় মাত্রার জগতের জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন সূত্রগুলোর আবিষ্কার তথা উদঘাটন করছে আর সেই সূত্রগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন- কারণ মানুষ, তথা জীবজগত যে শক্তির বলে জীবিত থাকছে আর সেই শক্তির অনুপস্থিতিতে মৃত বলে ঘোষিত হচ্ছে- সেই শক্তিকেই তারা মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখতে পাচ্ছে না বলে অস্বীকার করে বসেছে। মানুষ বা জীব ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সূত্রগুলো দিয়ে সুবিধা করতে পারলেও মানুষের ক্ষেত্রে সুবিধা করতে পারেনি- কারণ মানুষের মাঝে একই সাথে বহু মাত্রার সমন্বয় ঘটেছে- মানুষের জাগতিক দেহের সাথে আছে তার মন, আবেগ, চিন্তাধারা, বুদ্ধিমত্তা, ইচ্ছাশক্তি; আরো গভীরে বললে তার আছে অপার্থিব অস্তিত্বও। তাই মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে মানুষকে শুধু রক্ত-মাংশের পিণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে- এই বস্তুবাদী বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
হোমিওপ্যাথি হচ্ছে একই সাথে দর্শন ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা (Holistic system) পদ্ধতি। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে মানুষকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হয়। এই সামগ্রিক বিবেচনা করতে গিয়ে শুধু মানুষের শরীর নয়- মন মানসিকতা, এই মহাবিশ্বের সাথে মানুষের সর্ম্পক ইত্যাদিকে বিবেচনায় আনতে হয়। আর এই বিবেচনা করতে গিয়ে হোমিওপ্যাথিতে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর জানতে হয়। প্রথমেই জানতে হয়- মানুষ আসলে কি? মানুষ কি শুধু রক্ত মাংশে গড়া একটি বস্তু! না মানুষ হচ্ছে একই সাথে বহুমাত্রার সমন্বয়ে গঠিত স্রষ্টার এক অর্পূব সৃষ্টি। তারপর জানতে হয়- রোগ কি? রোগী কে? রোগ কেন হয়? আরোগ্য কি? আরোগ্য কিভাবে সংগঠিত হয়? ইত্যাদি। যে প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া জানা সম্ভব নয়। কারণ বস্তুবাদী বিজ্ঞান এর সঠিক উত্তর দিতে অপারগ।
মূলত এই মহাবিশ্ব (Universe) এক সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। এই নিয়মগুলোকে আমরা প্রাকৃতিক নিয়ম (Natural law) বা সূত্র বলে জানি। আমরা এই মহাবিশ্বের একটা অংশ মাত্র। হোমিওপ্যাথির মতে, মানুষ চালিত হচ্ছে এক অদৃশ্য অতীন্দ্রিয় শক্তি দিয়ে যা জীবনীশক্তি নামে পরিচিত। যে শক্তির অনুপস্থিতিতে মানুষকে মৃত বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সমগ্র মানবদেহে এই শক্তির একটি সুষম প্রবাহ বিদ্যমান থাকে। এই শক্তির সুষম প্রবাহের উপরেই মানব দেহের সুস্থতা নির্ভর করে থাকে। যদি কোন কারণে এই শক্তির সুষম প্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি হয়- তখনই মানুষ রোগাক্রান্ত হয়।
শক্তির প্রবাহে বাধা কেবল শক্তিই তৈরি করতে পারে হোমিওপ্যাথির মতে রোগ (Disease) হচ্ছে এক প্রকার শক্তি যা জীবনীশক্তির বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। যখন জীবনীশক্তি এই রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন তার ফলস্বরূপ মানব অস্তিত্বে (Human Existance) বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায়- যা আমরা রোগলক্ষণ (Symptoms) হিসেবে প্রত্যক্ষ করি। তাই আবার এই রোগশক্তিকে দূরীভূত করতে হয় আরেকটি শক্তি দিয়ে যা হচ্ছে ঔষধশক্তি। এ জন্য হোমিওপ্যাথির মৌলিক নীতিগুলোর একটি হচ্ছে- শক্তিকৃত ঔষধ (Potency medicine) ব্যবহার করা। আর এই পুরো ব্যাপারগুলোই হচ্ছে শক্তিস্তরে (Dynamic level)-যা দেখা যায় না এবং এই বস্তুবাদী বিজ্ঞানের একপেশে পদ্ধতিগুলো দ্বারা প্রমাণও করা যায় না। ঘটনার ফল দেখে পুরো ব্যাপারটি আমাদের উপলব্ধি করে নিতে হয়।
হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রটি গড়ে উঠেছে জীবনীশক্তি-রোগশক্তি-ঔষধশক্তি এই মৌলিক তত্ত্বগুলোর উপর ভিত্তি করে। এই মৌলিক তত্ত্বগুলোকে পুরোপুরি উপলব্ধি তথা বুঝতে না পারলে হোমিওপ্যাথিকে বোঝা সম্ভব নয়। এই ব্যাপারগুলো ভালো করে না বুঝে শুধু হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রায়োগিক অংশটুকু অনুসরণ করে, কিছু লক্ষণ মিলিয়ে ঔষধ প্রয়োগ করলেই হোমিওপ্যাথি হয় না। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যে সকল পদ্ধতি অনুসরণ করে হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে রোগী চিকিৎসা করতে হয় তার ভিত্তি রচিত হয় হোমিওপ্যাথির দর্শনের জ্ঞানের উপর। আমরা জানি বস্তুবাদী বিজ্ঞানের চিন্তা করার পদ্ধতি ও দর্শনের চিন্তা করার পদ্ধতি আলাদা। আসলে বস্তুবাদী বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ই দাঁড়িয়ে আছে বস্তুবাদীদের অস্বীকার করা দর্শনের ভিত্তির উপর। কাজেই, দর্শনের জ্ঞান ছাড়া কেবল এর প্রায়োগিক বিজ্ঞানকে বুঝতে যাওয়াটা হবে ভিত্তি ছাড়াই ঘর তৈরি করার মতো; কঙ্কাল ছাড়া মানবদেহের মতো অবস্থা। আর এ কারণেই দার্শনিক দৃষ্টি ছাড়া হোমিওপ্যাথিকে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা সম্ভব নয়।
Dr. Shohidujjaman
Govt reg: 34225
DHMS(BHB), BAgEd(Dhaka)
Homeopathist, General Practitioner.
Regular consultant of SALEEMÕS CLINIC
EMAIL: dr.shohidyyuaman@gmail.com
Phone: 01787062323