Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / জাতীয় / খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের মুখে বাংলাদেশ - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের মুখে বাংলাদেশ

November 01, 2022 11:05:08 PM   জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের মুখে বাংলাদেশ

সাঈদ বিন তারিক:

মহামারী আর যুদ্ধের সঙ্কটে তিনটি বছর পার করা এই পৃথিবীর আগামী বছরটাও যে অর্থনৈতিকভাবে ভালো যাবে না, সেই পূর্বাভাস বিশ্ব সংস্থাগুলো দিয়ে আসছে। খোদ সরকারপ্রধান বার বার দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলে সতর্ক করে আসছেন দেশবাসীকে। সত্যি সত্যি যদি তেমন বিপদ আসন্ন হয়, তা সামাল দিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। প্রশ্নটা যৌক্তিক কারণেই এখন জোরালোভাবে উঠে আসছে বিশেষত যেখানে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট এখন খুব স্পষ্ট।
এই বিপদের মুখ অনেকগুলো, তার কয়েকটা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ দেখতে শুরু করেছে। টানা কয়েক বছর বাড়তে থাকা বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার এখন নিম্নমুখী। বিশ্বের জ্বালানি বাজারের অস্থিরতা ফিরিয়ে এনেছে বিদ্যুতের লোড শেডিং।সহসা খাদ্য সঙ্কট তৈরি হওয়ার স্পষ্ট কোনো ইংগিত এখনও সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির সার্বিক সঙ্কটে মূল্যস্ফীতি বহু বছর পর এখন ৯ শতাংশের উপরে থাকছে। তাতে নিম্ন আর মধ্যবিত্তের সংসার সামলাতে উঠছে নাভিশ্বাস।

খাদ্য সংকট নিয়ে সর্তক বার্তা এসেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। গত প্রায় এক মাসে তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন তা এরকম: বাংলাদেশকে যেন দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়তে না হয়, তাই দেশের পতিত আবাদ জমির প্রতিটি ইঞ্চি কাজে লাগাতে হবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য। কারণ, সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট ও দুর্যোগ দেখা দেয়ার, দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জনসাধারণকে খাদ্যের অপচয় বন্ধ করতে ও নিজেদেরকে যার যেখানে যতটুকু সম্ভব খাদ্য উৎপাদনের চেষ্টা করারও আহবান জানিয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনার এই সতর্কবার্তা তাৎপর্যপূর্ণ।  বস্তুত এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা অদূর ভবিষ্যতে বিশেষত ২০২৩ সালে দুনিয়াজুড়ে বড় ধরনের খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ার কথা জানিয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্বব্যাংক খাদ্য সঙ্কটের যে ঝুঁকির কথা বলছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের নামও আছে। 

খাদ্যের জন্য বাংলাদেশ যেহেতু অনেকটাই বিশ্ব বাজারের ওপর নির্ভরশীল, তাই  বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি কিছুটা ব্যহত হলেই তা দেশের ভেতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে- অতীতে বিভিন্ন সময়ে এটা দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আনতে হয়- এমন বেশ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম গত কয়েক মাসে লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এর পেছনে রয়েছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা। ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, প্রসাধনী, জরুরি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মত পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে চাপ আরও বেড়েছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার নিয়মিত সাময়িকী (প্রান্তিক) ক্রপস প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশনের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে বাড়তি খাদ্য আমদানির প্রয়োজন হবে, এসব দেশের মধ্যে ৩৩টিরই অবস্থান আফ্রিকায়। ওই তালিকায় বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৯টি দেশেরও নাম রয়েছে। আফ্রিকায় খরার কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে গিয়ে দুর্ভিক্ষের মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে। আর বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় চলতি বছর চার লাখ টন কম হতে পারে বলে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ধারণা। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরে ধানের উৎপাদন হবে পাঁচ কোটি ৬৪ লাখ টন, যা গত বছর ছিল পাঁচ কোটি ৬৮ লাখ টন। তবে গমের উৎপাদন এক লাখ টন বৃদ্ধি পেয়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। 

সরকারের হিসাবে, দেশের মানুষকে খাওয়াতে বছরে মোটামুটি তিন কোটি ৫০ লাখ টন চাল এবং ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন আটা লাগে। চালের প্রায় শতভাগ এবং গমের ১০ শতাংশের মত দেশীয় জোগান থেকে আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে তখন চাল আমদানি করতে হয়। বর্তমানে সরকারি গুদামে প্রায় ১৬ লাখ টন খাদ্যের মজুদ আছে। এর মধ্যে চাল প্রায় ১৪ লাখ টন, গম এক লাখ ৮০ হাজার টন। আর গুদামে ধান আছে ২০ হাজার টন। চলতি আমন মৌসুমে এক কোটি ৫৯ লাখ টন চাল পাওয়ার আশা সরকার করছিল। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এসে কিছু ক্ষতি করে দিয়ে গেছে, যদিও সেই ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ হয়নি। এতসব বিপদের মধ্যে নতুন করে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে কিংবা বীজ, সেচ বা সার নিয়ে সংকট তৈরি হলে খাদ্য উৎপাদন ধাক্কা খাবে। তখন খাদ্য আমদানি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে চাল আমদানির কিছু প্রস্তুতি সরকার ইতোমধ্যে নিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমদানি মানেই ডলার খরচ। তাতে আরও চাপ পড়বে রিজার্ভে। সব বিপদ সেই এক জায়গাতেই গিয়ে ঠেকছে।

জ্বালানি সংকট থেকে বিদ্যুৎ বিপর্যয়:
অন্যদিকে দেশে জ্বালানি সংকট এখন খুবই স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবার কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন, প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ রেখে শিল্পখাতে গ্যাস দেয়া হবে। কারণ, গ্যাস-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ইতোমধ্যেই সংকটের মধ্যে পড়েছে। তাই শিল্পে গ্যাস জোগান দিতে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে অবস্থা, তাতে বাড়তি দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি তথা তরলীকৃত প্রাকৃতি গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।
অথচ মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে তিনিই আমদানি-নির্ভরতার জন্য বিদ্যুৎ সংকটের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে দ্রুত হাঁটতে থাকে বাংলাদেশ, অগ্রাহ্য করা হয় অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে। আর এটা সবারই জানা জ্বালানি গ্যাস ও তেলের বিশ্ববাজার বরাবরই স্পর্শকাতর। আর তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে এই বাজারকে অস্থির ও ব্যয়বহুল করে তুলেছে তা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, আরো কমিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপ এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াচ্ছে বিকল্পে হিসেবে। হঠাৎ এলএনজির চাহিদা বাড়ায় দাম বেড়ে তা ব্যয়বহুল হয়ে গেছে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতো, তাহলে হয়তো এলএনজি আমদানি করে আরো কয়েকমাস চালানো যেত। তবে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়ে গেছে। তাই সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যেন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যায়। জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়ে ফেলা করা তার একটা অংশ।

বস্তুত আসন্ন খাদ্য সংকট ও বিরাজমান জ্বালানি সংকটের জন্য অদূরদর্শী আমদানি নির্ভরতার নীতি যে বহুলাংশে দায়ী তা এখন স্পষ্ট। সম্ভবত ধরেই নেয়া হয়েছিল যে বিশ্ববাজার বরাবরই স্থিতিশীল থাকবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অটুট থাকবে। আর তাই আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না। তারপরও যখন সমস্যার আভাস মিলছিল, তখনো সবকিছু ‘ঠিক আছে’ নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এখন যখন দ্রুত রিজার্ভ ক্ষয়ে যাচ্ছে স্বল্পমেয়াদি অথচ উচ্চ সুদের বেসরকারি ঋণ পরিশোধ করতে এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াতে, তখন সবকিছু আর ঠিক থাকছে না।

বিশেষজ্ঞদের মত:
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন খাদ্য সংকটের চেয়ে শিল্প কারখানা সচল রাখার দিকে বেশি নজর দিতে বলছেন। তিনি বলেন, “আমাদের খাদ্য উৎপাদন চিত্রে এমন কিছু আসেনি যে এখন শঙ্কিত হতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম খুব বেশি বাড়েনি। গমের প্রাপ্যতা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। আমি খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ কিংবা চরম দারিদ্র্য- এমন কিছু দেখছি না। আমরা তো ইউক্রেইন কিংবা রাশিয়ার কাছ থেকে চাল আমদানি করছি না। গম যা লাগে সেটাও ভারত থেকে আসে। ভারত থেকে গম আনতে আমাদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে আবাসিক এলাকায় সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে কৃষি ও শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ শিল্পের সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক রয়েছে।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “রিজার্ভ এখন যেখানে নেমেছে সেটা অবশ্যই অস্বস্তির। কিন্তু এটা যাতে আর নিচে না নামে, সেজন্য কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। রিজার্ভ ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে কিছু চাল ও গম আমদানি করতে হলেও সেটা করা যাবে।” আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ চার মাসের মত আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারবে। খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতেরও যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা মনে করিয়ে দিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তুতি থাকলেও সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতার কারণে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে দেশের একাংশ এখনও লোড শেডিংয়ে আক্রান্ত। সেচের মৌসুমে এই লোড শেডিং থেকে যাতে বের হওয়া যায়, তার জন্য এখনই কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ফেলতে হবে। কিছু সেচ পাম্পে সোলার পাওয়ার যুক্ত করার যে পরিকল্পনা চলছে সেটাকেও ত্বরিত গতিতে আগাতে হবে।”