
রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করেছে দলটি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী দিনে দলটি আন্দোলন করবে। গণসমাবেশের প্রধান অতিথি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বর্তমান অবৈধ সরকারের আর এক মুহূর্ত ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই। ১০ দফা দাবির মাধ্যমে যুগপৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকারের পতন ঘটানো হবে।
শনিবার দুপুর ১টার কিছু পরে সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলা ও ঢাকা মহানগরের নেতারা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। বিএনপির অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের মতো ঢাকার গণসমাবেশেও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য আলাদা চেয়ার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সশরীরে বিএনপির এই দুই শীর্ষ ব্যক্তি উপস্থিত না থাকতে পারলেও তাদের ছবি চেয়ারে বসিয়ে প্রতীকী অতিথি বানানো হয়েছে।
বিএনপির গণসমাবেশ শুরু হওয়ার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠ। পরে আশপাশের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েন বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলটির নেতাদের দাবি, ঢাকার গণসমাবেশে কয়েক লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে। বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যেই এক ধরনের উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে। এই সমাবেশ থেকেই সরকার পতনের লাগাতার আন্দোলনে নামবে বলে মনে করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নেতাকর্মীরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকার আজকের গণসমাবেশে বাধা দেওয়ার জন্য নানান ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের সাড়ে চারশোর বেশি নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। তবে সব বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে আজকের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল হয়েছে।’
সমাবেশের শেষ দিকে ১০ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিতে বলা হয়, বর্তমান অনির্বাচিত, অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ভোটবিহীন, গণতন্ত্র হরণকারী, লুটেরা ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮ খ, গ ও ঘ- এর আলোকে দলনিরপেক্ষ একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ অন্তর্র্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান অবৈধ নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। এই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করতে হবে। খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী, পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী সব মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের সাজা বাতিল, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দীদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। দেশে সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা। সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দল কর্তৃক কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা। স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার যাবে না।
এছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, সন্ত্রাস দমন আইন-২০০৯ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, সার, পানিসহ জনসেবা খাতগুলোয় মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে।
িত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, শিশুশ্রম বন্ধ করা ও কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। গত ১৫ বছরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত, শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। ত ১৫ বছরে গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার করতে হবে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার আইনানুগ বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর ও সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের উপযোগী করার লক্ষ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা, যশোর, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঢাকা মহানগরীয় গণসমাবেশ অংশ নিয়েছেন। সমাবেশ উপলক্ষে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সড়কের মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। ডিবিপ্রধানের তথ্যমতে আজ প্রায় ২০ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য রাজধানীতে নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও যাত্রাবাড়ী, পল্টন, আরামবাগ, কমলাপুর, মতিঝিল ও রাজধানী মার্কেট সহ আশেপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া সমাবেশকে ঘিরে র্যাবের হেলিকপ্টার টহল এবং গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক টিম কাজ করেছে।
এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্তি ও গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে আগামী ১৩ ডিসেম্বর সারা দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল করবে বিএনপি। এরপর ২৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সব মহানগর ও জেলা সদরে গণমিছিলের ডাক দিয়েছে বিএনপি। এটা হবে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি। এই গণমিছিলে যোগ দিতে সব সমমনা দল এবং সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিএনপির সব সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ:
এদিকে গোলাপবাগ মাঠে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ চলাকালীন সেখানেই একাদশ জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সব সদস্য পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন। সমাবেশে বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ প্রথম পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরপর অন্য সংসদ সদস্যরা একে একে পদত্যাগের কথা জানান। দেশের বাইরে থাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদের পক্ষে গোলাম মোহাম্মদ পদত্যাগের কথা জানান। একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপির সংসদ সদস্যরা হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের মো. আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের আবদুস সাত্তার, বগুড়া-৪ আসনের মো. মোশাররফ হোসেন, বগুড়া-৬ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান এবং বিএনপির সংরক্ষিত সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। সমাবেশে রুমিন ফারহানা বলেন, আজ রোববার তারা জাতীয় সংসদে পদত্যাগপত্র পাঠাবেন।
এর আগে নয়টি বিভাগীয় শহরে সমাবেশের সময় জানানো হয়েছিল, ঢাকার এই সমাবেশ থেকেই তাদের আন্দোলনের পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করা হবে। তারা বলেছিলেন, এই সমাবেশে ‘চার্টার্ড অব ডিমান্ড’ ঘোষণা করা হবে, যার লক্ষ্য হবে ‘সরকারের পতন ঘটানো’। গতকালের এই সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি গত আড়াইমাস ধরে দেশজুড়ে যে সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে আসছিল, তা শেষ হলো।