
দেড় মাসেও বন্ধ হয়নি সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি, মর্টারের গোলা নিক্ষেপ ও হেলিকপ্টার থেকে গোলা ছোড়া। দিনে থেমে থেমে কয়েকটি গোলাবর্ষণ হলেও, এখন রাতেও হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হচ্ছে গোলা। তাই কোনোভাবেই আতঙ্ক কাটছে না সীমান্তের বাসিন্দাদের। এরই মধ্যে আতঙ্কে অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন দোকানপাট। ভয়ে মাঠে কাজকর্ম প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্তে চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)।
তুমব্রু বাজারে সবসময় থাকত মানুষের আনাগোনা। কিন্তু সেই বাজার এখন প্রায় জনশূন্য। নেই মানুষের ভিড়, অনেক দোকানপাট বন্ধ। সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধ না হওয়ায় অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে। তবে এই গোলাগুলি কবে বন্ধ হবে জানেন না কেউ; তাই উৎকণ্ঠায় এলাকাবাসী। তুমব্রু সীমান্তের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিন বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলা মর্টারের গোলা কিছুদিন আগে এসে পড়েছিল তার বাড়ির খুব কাছে। তবে মর্টারের গোলা বিস্ফোরিত না হওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু এই আতঙ্ক কোনোভাবেই কাটছে না তাদের। আর এখনো অব্যাহত রয়েছে গোলাগুলি ও গোলাবর্ষণ। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি। কখন যে আবার গোলা এসে পড়বে। কারণ, প্রতিদিনই গোলাগুলি ও মর্টারের গোলা ছোড়া হয়। দিনের পাশাপাশি রাতেও মর্টারের গোলা ছোড়া হয়। রাতে ঘুমও হয় না আতঙ্কে। কখন যে আমাদের মাথার ওপর পড়ে।’
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তের পাশের ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপের তুমুল সংঘর্ষ হয়। তখন গুলি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়তে পারে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে জরুরি মুহূর্তে সীমান্তের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়া হবে। তিনি জানান, শুধু জরুরি মুহূর্তেই তালিকার ৩০০ পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হবে। অন্যত্থায় তারা নিজ বাড়িতেই অবস্থান করবে।
এদিকে উখিয়ার পালংখালী সীমান্তের আঞ্জুমানপাড়া, পূর্ব ফারির বিল ও বটতলি এলাকায় জীবিকার একমাত্র উৎস চাষাবাদ, মৎস্য ঘের ও খালে যেতে পারছেন না এলাকার কৃষক, দিনমজুর ও জেলেরা। সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি ও মর্টারের গোলার বিকট শব্দ ভেসে আসছে প্রতিনিয়ত। বটতলি গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার বলেন, ‘মিয়ানমারের ওপারের গোলাগুলি হচ্ছে, আর আমরা এপার থেকে তা দেখছি। কোন স্থানে গোলা মারছে তা তো দেখছি, বুধবার বেশি গোলা মেরেছে। আগে হেলিকপ্টার থেকে গুলি মেরেছে। কিন্তু বুধবার কী গোলা মেরেছে জানি না; তবে এসবের বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠেছে।’
আরেক বাসিন্দা সোয়েব বলেন, ‘গোলাগুলি হচ্ছে; সীমান্তে আগে আমরা যেতে পারতাম। কিন্তু এখন গোলাগুলির কারণে যাচ্ছি না, আতঙ্কে আছি।’ পূর্ব ফারির বিলের সিদ্দিক আহমদ বলেন, ‘বিকট শব্দের কারণে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠছে। আমরা মনে করছি, ভয়ংকর ভূমিকম্প হচ্ছে। আর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ভয়ে চিৎকার করছে।’ মৎস্য ঘেরের শ্রমিক আক্কাস বলেন, ‘মিয়ানমারে যে অবস্থা শুরু হয়েছে, কোনোভাবেই আমরা বাংলাদেশি মানুষ মাছের ঘেরে থাকতে পারছি না। কারণে বেশি বোমা মারছে।’
বটতলি গ্রামের কৃষক আমির হোসেন বলেন, ‘পাঁচকানি চাষাবাদ করেছি; কিন্তু তা দেখভাল করার জন্য যাতায়াতের অসুবিধা হচ্ছে, যেতে পারছি না।’ আঞ্জুমানপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলম বলেন, ‘ধান চাষ করেছি এবং ঘেরে মাছ চাষও করছি। গোলাগুলির কারণে আমাদের ভয় লাগছে, এখন যেতে পারছি না। নিরাপত্তার স্বার্থে বিজিবিও যেতে বাধা দিচ্ছে, মাছও শিকার করতে পারছি না।’ উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জাফরুল ইসলাম বলেন, ‘মিয়ানমারের আগ্রাসী আচরণে সীমান্ত এলাকার মানুষ এখন চরম আর্থিক সংকটে পড়ছে।‘
এদিকে শুধু তুমব্রু সীমান্তের ৩০০ পরিবারই নয়, কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তেও অতি ঝুঁকিতে থাকা ১০০ পরিবারের তালিকা হয়েছে। জরুরি মুহূর্তে প্রয়োজনে তাদেরও সরিয়ে এনে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে প্রশাসন।