Date: May 20, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / পীরদের সুযোগসন্ধানী রাজনীতি - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

পীরদের সুযোগসন্ধানী রাজনীতি

February 01, 2023 05:28:29 PM   সম্পাদকীয়
পীরদের সুযোগসন্ধানী রাজনীতি

সাঈদ বিন তারিক

বাংলাদেশে ইসলামের আগমন এবং তার প্রচার-প্রসারে সুফি, দরবেশদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে তাঁরা চলে যাওয়ার পর তাঁদের মাজারের পাশে তাদের বংশধরেরা শুরু করে পীর-মুরিদী ব্যবসা। এখনকার সময়ে পীর মানেই একজন ছোটখাটো রাজা। সম্পদে-সম্মানে তারা রাজার মতোই জীবনযাপন করেন। সাধারণত তারা এত বেশি আরামপ্রিয় হন যে, গদিমোড়া আরামকেদারায় বসে এক ঘণ্টার ওয়াজ করার সময়ও তাদের পায়ের নিচে নরম তুলতুলে বালিশ দিতে হয়।
পীররা সাধারণত ভক্ত মুরিদদের সেবা যত্ন বা সালাম শ্রদ্ধা পেয়ে অভ্যস্ত হন। তাদের ছেলে মেয়েরাও একই পরিমণ্ডলে বড় হয়। তারাও ছোট বেলা থেকে নিজেদেরকে ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র ভাবতে শেখেন। অঢেল সম্পদের মধ্যে বড় হন, আর তার বেশিরভাগেরই জোগান আসে মুরিদদের পক্ষ থেকে। তারা দেওয়া নয়, নেওয়ার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হন। তাদের মধ্যে এক ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন মানসিকতার জন্ম হয় ছোটকাল থেকে। সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে তারা নিজেদের আলাদা ভাবতে শেখেন। তারা নিজেদের উঁচু আসনের মানুষ ভাবতে শেখেন। সুতরাং তাদের দ্বারা রাজনীতি করা, জনতার সেবা করা, জননেতা হওয়া খুব একটা সহজ হয় না। তবুও আশির দশকের শেষ দিকে কয়েকজন পীর বা সুফি নেতা ইসলামপন্থী দল গঠন করে রাজনীতির মাঠে নামেন। 
জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময় রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি নিয়ে যেসব কাজ করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব আরো বেড়ে যায়। বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল এবং সংগঠনকেও মদদ দিতে থাকেন এরশাদ। রাজনৈতিক সংকট সামাল দিতে সংবিধানে তিনি রাষ্ট্রধর্মের ধারণা নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু মুসলিম সেজন্য তাদের খুশি করতে তিনি এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কারণ নানা দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিতর্ক নিয়ে এরশাদ তখন জর্জরিত। যদিও এরশাদের প্রবর্তিত সে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি পরবর্তীকালে কোন সরকার বাতিল করেনি। এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই তখন দল গঠন করে পীরদের রাজনীতিতে নামতে দেখা গেছে।
এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৭ সালে চরমোনাই পীরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। তখন তারা ইসলামি ঐক্যজোট নামে ইসলামপন্থী দলগুলোর জোটে ছিল। পরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা  ইসলামি ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে জাতীয় পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী জোট করে। সেখানেও কোন দাম না পেয়ে ২০০৬ সালের পর থেকে তারা একলা চলার নীতি গ্রহণ করে। তবে সেই একলা চলার নীতি তারা কতটুকু ধরে রেখেছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ বরাবরের মতোই দেখা গেছে, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের আদর্শ যাই হোক না কেন তারা ক্ষমতাসীন দলের সান্নিধ্য পেতে ভালোবাসেন, তাদের গুডবুকে থাকার চেষ্টা করেন। এবং এই গুডবুকে থাকার মধ্য দিয়ে তাদের আসল যে পীর-মুরিদী ব্যবসা তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার পথ প্রশস্ত করেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সর্বদাই কোন না কোন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ২০০১ সালে সবচাইতে বড় ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় গিয়েছেল বিএনপি। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ের পর যুদ্ধাপরাধের বিচার করে জামায়াতকে মাঠছাড়া করেছে। সেসময় অরাজনৈতিক দল হলেও নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করে, সরকারকে হুমকি-ধামকি দিয়ে তাদের একপ্রকার ব্যবহার করার আহ্বান জানায়। এবং আওয়ামী লীগও নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। হেফজাতের প্রধান দুই নেতা শফী-বাবুনগরী অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরলোকগমণ করলে দলটি একপ্রকার গর্তে ঢুকে যায়। এই অবস্থাতে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে মাঠে নেমেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হেফাজতের আদায় করা সুযোগ-সুুবিধাগুলো এবার তারা পেতে চান।
ইসলামপন্থী দলগুলো ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাকেই তাদের দলের মূল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি করে তারা কতটা এ কাজে সফল হতে পারবেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে অনেকে বহির্বিশ্বের উদাহরণ টানেন, কিন্তু তাদের এটাও মনে রাখতে হবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেসব দলগুলো ক্ষমতার মধু পুরোটা উপভোগ করতে পারেনি। এর আগেই কট্টরপন্থী নীতির কারণে ব্যাপক জনরোষের মুখে তাদের গদি ছাড়তে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতিতে এবং দেশ শাসনের ব্যাপারে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সমর্থন করে না। কারণ দেশ শাসনের ব্যাপারে ধর্মভিত্তিক দলগুলো বিশদ কোন পরিকল্পনা তারা জনগণের সামনে তুলে ধরে না। বিশ্বায়নের এই যুগে অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে বাদ রেখে যে দেশ শাসন করা যাবে না- তা তারা বুঝেন না। অবশ্য তারা না বুঝলেও জনগণ ঠিকই বোঝে। এজন্য তাদের সভা-সমাবেশগুলোতে লোকের আধিক্য থাকলেও ভোটের সময় তা নগণ্য হয়ে যায়। আর এসব সভা-সমাবেশগুলোতে মানুষ যায় মূলত সওয়াব কামাইয়ের জন্য। জনগণকে এসব বলেই সেখানে নিয়ে আসা হয়। তাই সওয়াব কামাই শেষে সবাই যার যার বাড়িতে ফেরত যাবে এটাই স্বাভাবিক।
মূল কথা হলো, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ খুবই ঠুনকো। দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সংগ্রাম করে যাবে এমন মানুষের সংখ্যা সেসব দলে খুবই কম। যেহেতু পীর বা পীরের সন্তানরাই এসব দলের নেতা হন, তাই তাদের চালচলনেও উচ্চাভিলাষী মনোভাব প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা সুযোগসন্ধানী হিসেবেই পরিচিত। তারা ধর্মকে ব্যবহার করে লোক জড়ো করতে পারেন- এটাই তাদের মূল শক্তি। সেই শক্তি প্রদর্শনেই তারা ব্যস্ত থাকেন। কিছু কিছু রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করে, গর্জে উঠা বক্তৃতা দিয়ে সাধারণ মানুষকে সরকারের বা ভিন্ন মত-দলের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে, তওহীদী জনতার হামলার ভয় দেখিয়েই তারা আলোচনায় থাকতে চান।
বাস্তবে জননেতা হতে হলে জনগণের মধ্যে থাকতে হয়। জনগণের ভেতর থেকে উঠে আসতে হয়। নেতাকর্মীদের সুখে দুঃখে পাশে থাকতে হয়। বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান দিতে হয়। বাস্তব সমস্যার আধ্যাত্মিক বা পারলৌকিক সমাধান দিলে তা জনগণের কাছ গৃহীত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর একজন নেতার মধ্যেও এই গুণ দেখা যায় না। পীর হিসেবে পাওয়া মানুষের সমর্থন রাজনীতিতে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা আরো পোক্ত করাকেই তারা মূল লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছেন বলে মনে হয়।