
চাহিদা অনুযায়ী দেশে রমজানের ভোগ্যপণ্য ছোলা, চিনি, খেজুর, ভোজ্যতেল ইত্যাদির আমদানি ও সরবরাহ ‘পর্যাপ্ত পরিমাণ’ রয়েছে বলে সরকার জানিয়েছে। এরপরেও রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশিষ্টরা। এরই মধ্যে কিছু পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
আমদানিকারকদের মতে, রমজানে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে রমজান মাস শুরুর আগেই পণ্য আমদানি করে সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করা হয়। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধি, এলসির উচ্চ মার্জিন, উচ্চ শুল্কায়ন ইত্যাদি কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর পণ্যের দাম বেশি।
রমজান শুরুর সপ্তাহখানেক আগেই বাজারে দাম বেড়েছে খেজুরের। গত রমজানে নিম্নমানের খেজুর প্রতিকেজি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন একই খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, চাহিদা অনুযায়ী রমজানের ভোগ্যপণ্যের আমদানি পর্যাপ্ত। বিশেষ করে, সর্বশেষ তিন মাসে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) যে পরিমাণ খেজুর আমদানি হয়েছে, তা দিয়ে রমজানের চাহিদা ভালোভাবেই মেটানো যাবে। ভোজ্যতেল বাদে ছোলা এবং চিনির বাজারের অবস্থাও একই। বিশ্ববাজারে দাম কমায় গত রমজানের তুলনায় এবার সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০-২৫ টাকা কমেছে।
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে গত তিন মাসে রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন ৪ ধরনের পণ্য ডেলিভারি হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ৮৬০ মেট্রিক টন। এই চার ধরনের পণ্য (ছোলা, চিনি, খেজুর ও ভোজ্যতেল) খালাস শেষে ইতোমধ্যে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “জাহাজ থেকে খালাসের পর দ্রুত শুল্কায়ন এবং ডেলিভারি কার্যক্রম সচল রাখতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষে ছয় ঘণ্টার মধ্যে বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি নিতে পারছেন আমদানিকারকরা।”
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য মতে, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত তিন মাসে খেজুর খালাস হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৪০ দশমিক ৭৯ টন। এছাড়া, গত তিন মাসে চিনি ১ লাখ ৬০১ টন, ভোজ্য তেল ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬৪ হাজার ৮ টন, ছোলা ৯১ হাজার ৩৫৪ দশমিক ৩৩ টন খালাস হয়েছে। রজমানকে কেন্দ্র করে আনা আরও প্রায় ৫ শতাংশ পণ্য খালাসের প্রক্রিয়ায় আছে বলে জানিয়েছে কাস্টমস।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। দেশে পরিবাহিত মোট কন্টেইনারের ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।
দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিত সাহা বলেন, “ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিসহ নানান সংকট থাকলেও দেশের চাহিদা অনুযায়ী রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য আমদানি করেছি। ফলে বাজারে কোনো পণ্যেরই সরবরাহ সংকট কিংবা দাম অস্থির হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা যাতে বাজার অস্থির করার সুযোগ না পায় সেক্ষেত্রে রমজানের আগ মুহূর্তে ভোক্তাদের একসঙ্গে পণ্য কেনার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিমাসে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা দেড় লাখ টন। রমজানে এই চাহিদা দাঁড়ায় ৩ লাখ টনে। একইভাবে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮–২০ লাখ টন। সেই হিসেবে চিনির মাসিক চাহিদা দেড় লাখ টন। তবে রমজানে সেটি বেড়ে ৩ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়।
দেশে প্রতিবছর ছোলার বাার্ষিক চাহিদা ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা হয় রোজার মাসকে কেন্দ্র করে। রমজানে ছোলার চাহিদা ১ লাখ টন। রোজার সময় পর্যন্ত ছোলা আমদানির পরিমাণ এক লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত তিন মাসে খেজুর খালাস হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৪০ দশমিক ৭৯ টন।
আমদানিকারকরা বলছেন, রমজান মাস ঘিরে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে, সেগুলো চাহিদার তুলনায় একই পরিমাণ। কিছু পণ্য চাহিদার তুলনায় বেশি। ফলে রমজানে সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক থাকবে। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধি, অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধি, শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর পণ্যের দাম বেশি।”
গত বছর প্রতিকেজি ছোলা বিক্রি হয়েছিল ৮০-৯০ টাকায়। এ বছর পর্যাপ্ত আমদানি সত্ত্বেও ডলার রেটের কারণে দাম কিছুটা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা কেজি।
একইভাবে খুচরা বাজারে চিনির দাম বেড়ে প্রতিকেজি ১৪২-১৪৫ টাকা হয়েছে, যা গত রমজানে বিক্রি হয়েছিল ১১০-১১৫ টাকা কেজি।
যদিও ভোজ্যতেলের দাম কমেছে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন লিটারপ্রতি ১৬০-১৬৫ টাকা, যা গত বছরে বিক্রি হয়েছিল ১৮০-১৯০ টাকায়।
চট্টগ্রামের হক ট্রেডিং-এর মালিক ও ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন, “বড় ব্যবসায়ীরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ ও মজুদ করছে। এরমাধ্যমে বাজারে একচেটিয়া পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে; ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
এদিকে, সিটি গ্রুপের উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) প্রদীপ করন দাবি করেন, “বিশ্বব্যাপী দাম কমলেও, উচ্চ বিনিময় হার এবং এলসি মার্জিনের কারণে আমদানি খরচ ২০-৩০% পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া, অনেক পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে সরকারি শুল্ক আরোপ হওয়ায় আগের চেয়ে দাম কিছুটা বেড়েছে।”
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “রমজান এলে নানান অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এবারও ছোলা, খেজুরসহ অন্যান্য পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় বেশি।”
বাজারে যৌক্তিক মূল্যে পণ্য বিক্রয় নিশ্চিত করতে সরকারের তদারকি সংস্থাগুলোকে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান তিনি।