Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / বিশেষ নিবন্ধ / মাসিকপত্র আখ্বারে এসলামীয়া, হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর অনন্য কীর্তি - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

মাসিকপত্র আখ্বারে এসলামীয়া, হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর অনন্য কীর্তি

February 04, 2023 07:18:17 PM   সম্পাদকীয়
মাসিকপত্র আখ্বারে এসলামীয়া, হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর  অনন্য কীর্তি

 শামিমা আক্তার সুমি
 

বাংলা চর্চায় মুসলিমদের অগ্রদূত
বাংলার মুসলমানদের ভাষা বাংলা হলেও উনিশ শতকে মুসলিম সমাজে বাংলার কদর ছিল না। তবে কোনো কোনো  ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তৎকালীন সময়ে আশরাফ বা সম্ভ্রান্ত মুসলমানরা নিজেদেরকে বাঙালির বদলে আরবি, ইরানি, তুর্কি কিংবা পাঠান বলে দাবি করত। যদিও তাঁরা বাস্তব প্রয়োজনে বাংলার ব্যবহার করত তবে  শিক্ষার ক্ষেত্রে আরবি, ফারসি বা অনন্যোপায় হয়ে উর্দুর চর্চা করত। এমনকি ‘রাজভাষা’ ইংরেজির চর্চাতে তাদের অনেকেরই কোনো আপত্তি ছিল না। আতরাফ বা সাধারণ মুসলমানদেক্রষ মধ্যেও এ প্রবণতা ক্রমেই বিস্তার লাভ করছিল। বাংলাকে হিন্দুয়ানি বা অনৈসলামিক ভাষা মনে করা হতো এবং এ ভাষায় ইসলামি গ্রন্থ-রচনা কিংবা কোরআন, হাদিস, ফিকাহ প্রভৃতির অনুবাদ অনুচিত বা ধর্মবিরোধী কাজ বলে মনে করা হতো। ঠিক এ রকম প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে কয়েক শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী পাঠান জমিদার ধর্মপ্রাণ পন্নী পরিবার বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চা শুরু করে যা তৎকালীন সময়ে এক বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়। 
এছাড়াও ব্রিটিশ শাসকদের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রচারের নীতি মুসলিমদেরকে ১০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছিল। ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণেও মুসলমানেরা ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদীক্ষাকে হারাম বলে মনে করত। এ অবস্থা থেকে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে টেনে তোলার জন্য পন্নী পরিবার বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর মধ্যে মাননীয় এমামুয্যামানের প্রপিতামহ হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী ও তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দানবীর ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চান মিয়া সাহেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর জীবন
সুলতান সোলায়মান খান কররানির ১৩তম বংশধর সা’দত আলী খান পন্নী টাঙ্গাইলের করটিয়ায় পন্নী বংশের ভিত প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৮৮০ খ্রিস্টব্দে সা’দাত আলী খান পন্নীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী (১৮৪৭-১৮৯৬) উত্তরাধিকারসূত্রে করটিয়ার জমিদারি লাভ করেন। কিন্তু হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী ১০ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান। অন্ধ হওয়ায় প্রকৃতপক্ষের জমিদারির যাবতীয় দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর মা জমরদুন্নেসা খানমের উপর। বর্তমানে গাজীপুর জেলায় অবস্থিত বালিয়াদীর জমিদার চৌধুরী হোসেন উদ্দিনের কন্যা জমরদুন্নেসা পূর্ব থেকেই জমিদারির কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং মোহরানা ও হেবাসূত্রে নিজ সম্পত্তির ব্যবস্থানার দায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করতেন। কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে কোনো বিনিময় ব্যতিরেকে কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করলে তাকে হেবা বলে। 
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী ১৮৭১ সনে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের একজন শাহজাদী আয়েশা খানমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন যিনি অটোমান সাম্রাজ্যের ৩১ তম সুলতান আবদুল মাজেদ  (Abdülmecid; 25 April 1823 – 25 June 1861) ভাগ্নী ছিলেন।
দৃষ্টিহীনতাও যাঁকে আটকাতে পারেনি
মাহমুদ আলী খান পন্নীর দৃষ্টিহীনতা তাকে সমাজচিন্তা বা জ্ঞানসাধনা থেকে বিরত রাখতে পারে নি। তিনি সর্বদার জন্য জ্ঞানী-গুণীজনদের দ্বারা পরিবৃত থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি শারীরিকভাবে অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন, তার অন্যান্য অনুভূতিগুলো দৃষ্টিমান ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুরধার। তার মেধা, চিন্তা ও বিচারক্ষমতা আজও প্রবাদতুল্য। বাল্যকালেই তিনি কোর’আন শরিফ মুখস্থ করে হাফেজ হিসেবে খ্যাতি পান। ফার্সি ও উর্দু ভাষাও তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ব্যক্তিজীবনে একনিষ্ঠ ধার্মিক মাহমুদ আলী সাধনা ও আধ্যাত্মিকতায় একজন উঁচু স্তরের কামেল ব্যক্তি হিসাবে সকলের কাছে সমাদৃত হন। তাঁর কর্মকাণ্ড অধিকাংশই ছিল ধর্মভিত্তিক। ইসলাম প্রচার তাঁর জীবনের একটা ব্রত ছিল। একাজে তিনি সুযোগ্য সাথী হিসেবে পান টাঙ্গাইলের সুরাজ (মতান্তরে চারান) গ্রামের মৌলভি মোহাম্মদ নঈমুদ্দীনকে। তাঁদের দুজনের প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় সংযোজিত হয়েছিল।
ছাপাখানা ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
করটিয়ায় সা’দাত আলী খান পন্নীর জীবদ্দশায় একটি প্রেস স্থাপিত হয়েছিল। বাংলাদেশে একজন মুসলমান জমিদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সম্ভবত এটিই প্রথম ছাপাখানা। পরবর্তীকালে হাফেজ মাহমুদ আলী করটিয়াতে ১৮৮৫ সালের ২২ মার্চ (১২৯১ বঙ্গাব্দে ৮ চৈত্র) একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। ‘মাহমুদিয়া যন্ত্র’ বা ‘মাহমুদিয়া প্রেস’ নামে পরিচিত উন্নতমানের এ প্রেসটি জমিদারির নিজস্ব কাজের পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিকে জাগ্রত করার জন্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। তাঁর প্রেস থেকে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ, পত্রিকা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। পন্নী পরিবারের প্রতাপ ও জনপ্রিয়তা এতই বিপুল ছিল তাদেরকে অবজ্ঞা করাও ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
করটিয়া জমিদার বাড়ির প্রেস হতে রসিকলাল বসু রচিত ‘আটীয়ার ইতিহাস’, ফতোয়ায়ে আলমগিরী (অনুবাদ), মওলানা নঈম উদ্দিনের জুবদাতুল মাসায়েল প্রভৃতি পুস্তক প্রকাশিত হয়। 
মুসলিম জাগরণে আখ্বারে এসলামীয়া
মাহমুদিয়া প্রেস থেকে হাফেজ মাহমুদ আলীর অর্থানুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ও মৌলবি নঈমুদ্দীনের সম্পদনায় ‘আখ্বারে এসলামীয়া’ নামে একটি মাসিকপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হত। এপ্রিল, ১৮৮৪ তে পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। দশ বছর চলার পার মাঝখানে দুই বছর বন্ধ থাকে। এপ্রিল, ১৮৯৫ অথবা ১৮৯৬ থেকে নতুন করে এর প্রকাশ শুরু হলেও মাত্র অল্প দিনের মধ্যেই পত্রিকাটি চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যায়। 
নবপর্যায়ে প্রকাশিত হওয়ার সময় পত্রিকার নামের নিচে লেখা হতো: ‘উপদেশ, ধর্মশালা, মুসলমানের পুরাবৃত্ত, প্রেরিত পত্র, বিবিধ সংবাদ প্রভৃতি সম্মিলিত মাসিক পত্রিকা’। ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, মহাপুরুষদের জীবনী, মুসলিম ঐতিহ্য এবং সমকালীন সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে এতে প্রকাশিত হয়েছে। শরা-শরিয়ত সংক্রান্ত রচনা ছিল পত্রিকার মুখ্য বিষয়। হানাফি-আহলে হাদীস ও গোবধ-গোরক্ষা বিষয়ে টাঙ্গাইলের আরেকটি পত্রিকা মাসিক আহমদীর সঙ্গে এ পত্রিকার দীর্ঘকালের বিতর্ক ছিল। মৌলবি নইমুদ্দীন স্বয়ং ইসলাম ধর্মে পণ্ডিত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে হিন্দু ধর্মে শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ছিলেন, মৌলবি নঈম উদ্দিন সে সময় ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে তেমনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় ছিলেন। গোবধ-গোরক্ষা সম্পর্কে তিনি মীর মশাররফ হোসেন এর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ২১ আষাঢ় ১২৯৬ বঙ্গাব্দে (১৮৮৯) মীর মশাররফ মৌলবি নঈমুদ্দীনের বিরুদ্ধে ‘আটিয়া প্রথম মুনসেফী আদালত’- এ একটি মানহানির মামলা দায়ের করেন। কিন্তু রায় প্রকাশের পূর্বেই ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর হাফেজ মাহমুদ আলীর বিশেষ প্রচেষ্টায় উভয়পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা বা ‘ছোলেনামা’ সাক্ষরের মাধ্যমে এই মামলার নিষ্পত্তি ঘটে। মামলাটি তৎকালে বহুল আলোচিত হয়েছিল। বিষয়টি হচ্ছে মীর মোশাররফ হোসেন গোজীবন নামে একটি প্রহসন লিখেছিলেন যাতে মুসলমান ও হিন্দুর সম্প্রীতি রক্ষার জন্য গরু কোরবানি স্থগিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল। মৌলবি নঈম উদ্দিন এই প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করেছিলেন এবং পাল্টা জবাব হিসাবে গো-কাণ্ড নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সমঝোতায় আসার পর মীর সাহেব ‘গোজীবন’ পুনঃমুদ্রিত করবেন না বলে আশ্বাস দিলে মৌলভী সাহেব তাঁর তারিফ করেন। আদর্শের দিক থেকে দুই সাহিত্যেকের মধ্যে কলমযুদ্ধ হলেও ব্যক্তিজীবনে তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল প্রচুর। প্রায়ই তাঁরা একত্র মিলিত হয়ে পারিবারিক সুখ-দুঃখ থেকে মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন।
নাম থেকেই বুঝা যায় আখ্বারে এসলামীয়া ছিল একটি ধর্মীয় পত্রিকা। খ্রিষ্টান, ব্রাহ্ম ও হিন্দু ধর্মের যেসব প্রভাব মুসলমান সমাজকে কলুষিত করছিল তা দূর করা এ পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। মফস্বল থেকে প্রকাশিত  হওয়ার কারণে অনেকে একে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখলেও সমকালীন মুসলিম সমাজের ওপর পত্রিকার যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে ফিচার ও মুসলিমজাহানের বিশেষ খবরাদি ছাপা হতো। এর প্রতিসংখ্যার সম্পাদকীয় কলামটি ছিল খুব আকর্ষণীয়। তাঁর সমাজ সংস্কারমূলক কাজগুলো পাঠকসমাজে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। এটি মুসলিম সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য। তৎকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারাদেশে চলতো এ পত্রিকা।
বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী করে আখ্বারে এসলামীয়া পত্রিকা। সে সময়ে করটিয়ার ‘আখ্বারে এসলামীয়া’ পত্রিকাটি ছাড়া সব ক’টি পত্রিকাই প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। বলা চলে, বাংলার মুসলমানদের সাংবাদিকতার এটাই ছিল সূচনা পর্ব।
জাতীয় জাগরণে জনমত সৃষ্টিতে সংবাদপত্র সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে যে দুই শতাব্দিব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে তাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে চেষ্টা করা হয়েছে। সনাতনধর্মী ও মুসলিমদের মধ্যে বহু সংগঠন ও পত্রিকা হয়েছিল যেগুলো ধর্মীয় চেতনাকে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে প্রবাহিত করেছে। উনিশ শতকের এই পত্রিকাটি তৎকালীন সময়ে সমসাময়িক মুসলিম সাহিত্য সাধনা ও ইংরেজ ও তাদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বর্ণহিন্দুদের যৌথ শোষণ-লুণ্ঠন, ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের কারণে পিছিয়ে পড়া বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মুসলমানগণ মূলত এই জাগরণ প্রয়াসের কাণ্ডারি ছিলেন। তবে এ কাজে সমাজহিতৈষী বিত্তবান মাহমুদ আলী খান পন্নী বিশেষ যত্নবান ছিলেন। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ ও রাজনীতিবিদ আবুল কালাম শামসুদ্দীন এ বিষয়ে পরবর্তীতে লিখেছেন, “বাঙ্গালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের সত্যিকার চেষ্টা হয় সম্ভবত ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়, যাদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।” বলার অপেক্ষা রাখে না যে মাহমুদ আলী খান পন্নী ছিলেন এদেরই অন্তর্ভুক্ত। তাঁর কাছে বাংলার মুসলমানেরা নানাভাবেই ঋণী।
আখ্বারে এসলামীয়া ছাড়াও অন্যান্য পত্রিকার প্রতি হাফেজ  মাহমুদ আলী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ১৮৯০ সালে মীর মোশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে পা¶িক ‘হিতকরী’ প্রকাশিত হতো সম্পূর্ণরূপে টাঙ্গাইলের হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর আর্থিক সহায়তায়।
মুসলমানদের ‘প্রথম জাতীয় সংবাদপত্র’ হিসেবে অভিহিত ‘সুধাকর’ পত্রিকাটি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে আত্মপ্রকাশের পরপরই তীব্র আর্থিক সংকটে পড়ে । এ অবস্থায় তিনি ‘মোটা রকমের’ আর্থিক অনুদান প্রদানের মাধ্যমে পত্রিকাটি চালু রাখতে সহায়তা করেন। সম্ভবত তিনি পণ্ডিত রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী ও শেখ আবদুর রহিম প্রণীত ধর্মযুদ্ধ বা জেহাদ ও সমাজ সংস্কার (১৮৯০) গ্রন্থখানে প্রকাশেও সহায়তা করেছিলেন। এ গ্রন্থটি তাঁর নামে (হাফেজ মাহমুদ খান চৌধুরী) উৎসর্গ করা হয়। 
প্রথম বাংলা কোর’আন অনুবাদ
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী ও মৌলবি নঈমুদ্দীনের যৌথ প্রচেষ্টার একটি অনন্য সাফল্য হচ্ছে বাংলাভাষায় আল কোরআন অনুবাদ। উনিশ-শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত র¶ণশীল বাঙালি মুসলমান সমাজের কেউ মাতৃভাষায় কোরআন শরীফ অনুবাদে এগিয়ে আসেননি। আল-কোরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদ করেন ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন। তিনি ছিলেন ইসলাম সম্পূর্কে যথেষ্ট ধারণার অধিকারী এবং অনেকেই তাকে মৌলভী হিসেবে অভিহিত করত। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ‘১২ খণ্ডে কয়েকটি উপখণ্ডে’ গিরিশ চন্দ্রের অনুবাদকর্ম সম্পন্ন ও প্রকাশিত হয়। বাংলায় আল-কোরআনের এই অনুবাদ প্রকাশের সাথে সাথে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি সমাজে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কিন্তু অপে¶াকৃত কঠিন ভাষা ও কতিপয় শব্দের বিতর্কিত অনুবাদ, অনুবাদের সাথে মূল আরবি পাঠ না-থাকা এবং অনুবাদকের ইসলাম ধর্মাবলম্বী না-হওয়া প্রভৃতি কারণে র¶ণশীল বাঙালী মুসলিম সমাজে গিরিশচন্দ্রের অনুবাদ খুব বেশি জনপ্রিয় হতে পারেনি। এ অবস্থায় ধর্মপ্রাণ হাফেজ মাহমুদ আলীর উৎসাহ-অনুপ্রেরনায় ও সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মৌলবি গোলাম সারওয়ার-এর সহযোগিতায় বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রথম মৌলবি নঈমুদ্দীন ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে আল-কোরআন বঙ্গানুবাদের কাজ শুরু করেন। তিনি পবিত্র কোর’আনের টীকাসহ পূর্ণ অনুবাদ করেন যা ১৮৮৭ সনে করটিয়ার মাহমুদিয়া প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোর’আন শরীফের ১ম থেকে ১০ পারা পর্যন্ত সম্পূর্ণ, ১২, ১৩, ২২, ২৩, ২৭ ও ‘সহজ ও সুন্দর ভাষায়’ তাঁর অনূদিত কোর’আন শরীফ (বিশেষত আমপারা) সমকালীন মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় হয়। তাঁর কোর’আনের হাতে লেখা কপিটি এখনো সা’দত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। এর প্রকাশক ছিলেন মীর আতাহার আলী।
আল-কোর’আন ছাড়াও হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবি নঈমুদ্দীন বুখারী শরীফের অনুবাদের কাজও শুরু করেন। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ তাঁর এই অনুবাদকর্ম ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে করটিয়া থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি আরো প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেন। এভাবেই হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী সর্বপ্রথম কোরা’আন ও বোখারি শরিফ অনুবাদ করিয়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন যদিও তাঁর এই কীর্তি খুব কমই স্মরণ করা হয়।
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর ‘আদেশানুসারে’ মৌলবি নঈমুদ্দীন শরা বা ইসলামের মৌলিক বিধানসমূহকে উপজীব্য করে জুব্দাতুল মাসায়েল (১ম খণ্ড) বাঙালি মুসলিম সমাজে এত বেশি জনপ্রিয় হয় যে ১৮৭৩ থেকে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বইটির দশটি সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। এছাড়া হাফেজ মাহমুদ আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবি নঈমুদ্দীন ইনসাফ (১৮৮৬) ধোকা ভঞ্জন (১৮৮৯) গো-কাণ্ড (১৮৯৩) জুবদাতুল মসায়েল (২য় খণ্ড ১৮৯১) সেরাতল মস্তাকিম (১৮৯২) মৌলুদ শরীফ (১৮৯৫) সহ প্রায় ত্রিশটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ সকল গ্রন্থ মীর সা’দাত হোসেন বা মীর আতাহার আলী কর্তৃক করটিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।
ইসলাম প্রচার ও সমাজকল্যাণ
উপরে উল্লিখিত কর্মকাণ্ড ছাড়াও হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবি নঈমুদ্দীন ইসলামের সেবায় আরও কিছু পদ¶েপ নেন। এর মধ্যে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ‘আঞ্জুমানে মঈনুল ইসলাম’-এর প্রতিষ্ঠা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলাম প্রচারই ছিল এই সংগঠনের প্রধান বা মৌলিক উদ্দেশ্য। ধারণা করা যায়, সমকালীন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি আঞ্জুমানে মঈনুল ইসলামের সদস্য হয়েছিলেন। বিষাদসিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেন এই সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ইসলাম প্রচারক পত্রিকা থেকে জানা যায়, “আটিয়ার আঞ্জুমানে মঈনুল ইসলামের প¶ হইতে সম্পাদক মৌলভী নঈমুদ্দীন সাহেব ও করটিয়ার বিখ্যাত মৌলভী গোলাম সারওয়ার সাহেক বিভিন্নস্থানে ধর্মপ্রচার করিয়া বেড়াইতেছেন।’’ এ সংবাদ থেকে বুঝা যায়, সমকালে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে আঞ্জুমানে মঈনুল ইসলামের কর্মকাণ্ড বেশ সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছিল। 
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী হিন্দু ধর্মের উন্নয়নেও সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। ‘হিন্দুধর্মের রক্ষা ও উন্নতি কল্পে’ সিরাজগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত ‘আর্য্যধর্ম্ম প্রচারিণী সভা’- এর নতুন গৃহ-নির্মাণের জন্য তিনি দুইশত টাকা দান করেন। উল্লেখ্য, সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে পন্নীদের জমিদারি ছিল। যাহোক, এ তথ্য থেকে অন্যধর্মের প্রজাদের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ ও ধর্মীয় সহনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। 
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী শিক্ষা প্রসারের ¶েত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর পিতা সা’দাত আলী খান পন্নী করটিয়াতে একটি মাইনর স্কুল স্থাপন করেছিলেন। হাফেজ মাহমুদ আলী ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে এটাকে মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে (Middle English School) রূপান্তরিত করেন। সা’দাত আলীর সময় যে আরবি-ফারসি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় প্রকৃতপক্ষে তা ছিল একটি মক্তব মাত্র। হাফেজ মাহমুদ আলী প্রকৃত অর্থেই একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মৌলবি নঈমুদ্দীন, মৌলবি গোলাম সারওয়ার প্রমুখ দেশবরেণ্য ওলামা এই মাদ্রাসায় শিক্ষাদান করতেন। মাহমুদ আলীর সময়েই ১৩ চৈত্র ১২১৮ বঙ্গাব্দে (১৮৯২ খ্রি.) মূল্যবান পাথরখচিত ‘অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত’ করটিয়া এই মসজিদ ও মাদ্রাসার খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল। 
করটিয়া ছাড়া অন্যান্য স্থানে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও হাফেজ মাহমুদ আলী সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেন। অগ্রহায়ণ ১২৯৪ বঙ্গাব্দের আখ্বারে এসলামীয়া পত্রিকা থেকে ‘করটীয়ার সুপ্রসিদ্ধ ভূম্যাধিপতি শ্রীল শ্রীযুক্ত জনাব হাফেজ মাহমুদ আলী খাঁ সাহেব’ কর্তৃক ঢাকা মেডিকেল স্কুলের দালান নির্মাণের জন্য ‘পাঁচ সহস্র’ টাকা দানের কথা জানা যায়। তিনি ঢাকা মাদ্রাসার ডাফরিন মুসলিম হোস্টেল নির্মাণের জন্যও পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করেন। উল্লেখ্য, সে সময় প্রতিমণ ধানের দাম ছিল মাত্র আড়াই টাকা। অতএব, খুব সহজেই বুঝা যায়, সমকালীন বিচারে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ শিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করেছিলেন।
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিশোর বা তরুণ বয়সে ১৮৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে তিনি সিপাহী বা বিপ্লবীদের প¶ সমর্থন করেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আখ্বারে এসলামীয়া পত্রিকার একটি সংবাদ থেকে পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে, তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগদানে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং রাজনীতিতে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী ধারা অনুসরণের প¶পাতী ছিলেন।
হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর উৎসাহ-উদ্যোগ ও সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মৌলবি নঈমুদ্দীন ও মৌলবি গোলাম সারওয়ার প্রমুখের প্রাণপণ প্রচেষ্টায় ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে করটিয়া সমগ্র বাংলায় একটি অনন্য স্থান দখন করতে সমর্থ হয়। 
হাফেজ মাহমুদ আলীর সাথে সমকালীন কোনো জমিদার, বিশেষত মুসলিম জমিদারের তুলনা চলে না। তাঁর সময়ে করটিয়া ইসলাম প্রচার ও শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তার নামের স্মৃতি বহন করছে করটিয়ার  ঐতিহ্যবাহী শি¶াপ্রতিষ্ঠান এইচ. এম. ইনিস্টিটিউশন যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার জ্যেষ্ঠপুত্র দানবীর ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চান মিয়া সাহেব। এসএসসি পর্যন্ত এ স্কুলেই পড়াশুনা করেছেন এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তাঁর সময়ে বা তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর সময়ে করটিয়াতে বহু জ্ঞানী-গুণীর সম্মিলন ঘটেছিল। এদের মধ্যে মৌলবি নঈমুদ্দীন, মৌলবি গোলাম সরওয়ার ও কথা সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের কথা পূর্বেই সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া কবি ও ইসলাম প্রচারক মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (যশোর), মুন্সী জুমিরুদ্দীন, মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (সিরাজগঞ্জ), কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ কোনো না কোনোভাবে পন্নী পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। 
এমামুযযামানের পূর্বপুরুষগণ ব্রিটিশ শাসনকে কোনোদিনই হৃদয় থেকে গ্রহণ করেন নি, বরং তারা সর্ব উপায়ে চেষ্টা চালিয়েছেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্বাধিকার চেতনার অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করে তুলতে। মোঘল আমল থেকেই সিলেটে কিছু অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজশাহী পর্যন্ত, ময়মনসিংহ থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃতি বিরাট এলাকার জমিদার ছিলেন তারা। এই পন্নী পরিবারই মুসলিমদের মধ্যে শি¶াবিস্তার তথা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের বিস্তারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।
তথ্যসূত্র: 
১. ময়মনসিংহের সাময়িকী ও সংবাদপত্র- আলী আহম্মদ খান আইয়োব
২. বাংলায় মুসলিম জাগরণে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী- সুলায়মান কবীর
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. বিভিন্ন ওয়েবসাইট