
রিয়াদুল হাৃসান
ইসলামের প্রতিটি আমলের উদ্দেশ্য আমাদের পৃথিবীর জীবনকে উন্নত করা। একেকটি আমল আমাদেরকে একেক দিকে অগ্রসর ও সমৃদ্ধ করে তোলে যদি সেটাকে তার উদ্দেশ্য বুঝে সঠিক আকিদায় বাস্তবায়ন করা হয়। সওম বা রোজাও এমন একটি আমল যা প্রকৃতপক্ষে মো’মেনের চারিত্রিক উন্নতির একটি প্রশিক্ষণ, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে আমাদের জীবনে, আমাদের সমাজে। সওম আমাদেরকে শিক্ষা দিবে সংযম। ষড়রিপুর হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য সওম হচ্ছে ঢালস্বরূপ। (জাবির রা. থেকে মুসনাদে আহমাদ: ১৪৬৬৯)
কিন্তু সওম যদি সঠিক আকিদায় করা না হয়, তাহলে তা অর্থহীন হয়ে যাবে। একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে আল্লাহর রসুল বলেছেন, এমন একটা সময় আসবে যখন রোজাদারদের রোজা থেকে ক্ষুধা ও পিপাসা ব্যতীত আর কিছু অর্জিত হবে না। আর অনেক মানুষ রাত জেগে নামাজ আদায় করবে, কিন্তু তাদের রাত জাগাই সার হবে (অর্থাৎ নামাজ কবুল হবে না) (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)। সরল কথায়, সওম হবে উপবাস আর তাহাজ্জুদ হবে ঘুম নষ্ট করা। সওমের উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না অর্থাৎ তা সওম পালনকারীকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ (অহংকার) ও মাৎসর্য্য (হিংসা ) থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
এখনই সেই সময়। আমাদের সমাজে শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই পারতপক্ষে রমজান মাসের ফরজ সওম ভঙ্গ করে না। রোগীরাও পারতপক্ষে সওম ভাঙেন না, যদিও রোগীদেরকে আল্লাহ ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু সেই সওম যে ফলপ্রসূ হচ্ছে না তার প্রমাণ বাস্তব সমাজের দিকে দৃষ্টি দিলেই আমরা দেখতে পাই। সওম তো আমাদের সংযম শিক্ষা দেওয়ার কথা। লোভ থেকে, মিথ্যাচার থেকে বিরত রাখার কথা। কথা হচ্ছে, এই সওম যদি আমাদেরকে সংযমী করতো তাহলে একটা মুসলিমপ্রধান দেশে কীভাবে সওমের মাসে খাদ্যদ্রব্যের দাম সারা বছরের চেয়ে বেশি হয়?
এটা ইতিহাস যে, রসুলাল্লাহ (সা.) এবং সাহাবী ও তাবে-তাবেয়ীনদের যুগ থেকে শুরু করে সমগ্র সোনালি যুগে রমজান মাসে বাজার দর সবচেয়ে মন্দা যেত। বাজারে জিনিস পত্রের দাম থাকতো সব চেয়ে কম। কারণ ধনীগণ এ মাসে কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া করতেন কম। তারা নিজের জন্য ভোগ্যপণ্য কেনাকাটা না করে ঘুরে ঘুরে গরীব দুঃখীদের দান করতেন। স্বল্প ও সীমিত আয়ের লোকেরা যে খাবার ব্যয় বাহুল্য হবে মনে করে অন্য মাসে খেতে পারতো না। তারা রমজান মাসের মন্দা বাজারে তা কিনতে পারতো। কিন্তু বর্তমানে রমজান মাসে ধনীগণ খাদ্য বস্ত্র সব কিছুতেই বেশি ব্যয় করেন। তাদের বিত্তের আক্রমণে বাজারের হাল-হাকিকত হয় বেসামাল। একশ টাকার মাছ পাঁচ/ছয়শত টাকায় বিক্রি হয়। রমজান মাস আসার আগেই চাল, ডাল, আটা, চিনি, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, তেল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর মূল্যই ধাঁই ধাঁই করে বেড়ে চলে। এতে সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের অবস্থা রমজানে ত্রাহী ত্রাহী। অর্থাৎ প্রকৃত ইসলামের যুগের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। সংযমের কোনো চিহ্নই থাকে না, অন্য সময়ের চেয়ে খাওয়ার পরিমাণ ও ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। অথচ আল্লাহ বলেছেন, যারা কুফরী করেছে তারা ভোগ-বিলাসে লিপ্ত থাকে এবং পশুর মত আহার করে। তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম (সূরা মোহাম্মদ ১২)।
সওমের মাসে যদি সতিকার অর্থে সংযম থাকতো তাহলে মুসলিম বিশ্বে দারিদ্র্য থাকতো না। যারা অবস্থাসম্পন্ন তারা যদি সংযমী হতেন যে এই একটি মাস আমরা লোকদেখানো সংযম নয়, সত্যিকারভাবে সংযম করব; তাহলে যতটুকু তারা ব্যয় সংকোচন করছেন সেটা সমাজের মধ্যে উপচে পড়তো। পনেরো কোটি মুসলমানের মধ্যে পাঁচ কোটিও যদি সংযম করে, ক্ষুধার্তের কষ্ট উপলব্ধি করে সেই ভোগ্যবস্তু অন্যকে দান করত তাহলে জাতীয় সম্পদ এমনভাবে উপচে পড়ত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। সেটাই হতো সওমের বাস্তব প্রতিফলন। যদি অন্যান্য মাসে ভোজ্য তেলের লিটার থাকতো দুশ’ টাকা, এই মাসে থাকতো পঞ্চাশ’ টাকা। অন্যান্য মাসে গোশত যদি থাকতো ছয়শ’, টাকা এই মাসে থাকতো দুশ’ টাকা। কারণ মানুষ নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছে, চাহিদা থাকলেও খাচ্ছে না। ফলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে। যে এগারো মাস ঘুষ খায় সে যদি এই একটি মাসে না খায় তাহলে তার একটি বিরাট প্রভাব সমাজে পড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা উল্টোটাই দেখি। এই মাসটিকে ব্যবসায়ীরা বাড়তি উপার্জনের মাস হিসাবে নির্বাচন করে। খাদ্যে আরো বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়। টাকার জন্য মানুষ মানুষকে বিষ খাওয়াচ্ছে, সংযম তো দূরের কথা।
কথা ছিল, সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রভাব মানুষের শরীরের মধ্যে পড়বে, মনের মধ্যে পড়বে। এতে একদিকে ব্যক্তি পরিশুদ্ধ হবে, অন্যদিকে সমাজ সমৃদ্ধ হবে। বাস্তবে যখন এর উল্টো ঘটছে তার মানে দাঁড়াচ্ছে আমাদের সওম হচ্ছে না।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের ভোগবাদী সমাজ ইসলামের ছায়াতলে আসার পর কেমন পরিবর্তিত হয়েছিল সেটা ইতিহাস। যে সমাজে নারীকে ভোগ্যবস্তু মনে করা হতো, সেই সমাজে এমন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে একজন যুবতী নারী একাকী সারা দেহে অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ যেতে পারত, তার মনে কোনো ক্ষতির আশঙ্কাও জাগত না। মানুষ নিজের উপার্জিত সম্পদ উট বোঝাই করে নিয়ে ঘুরত, গ্রহণ করার মতো লোক খুঁজে পেত না। শেষে মুসাফিরখানায় দান করে দিত। আদালতগুলোয় মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ আসতো না। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পূর্বে আরবের গেফার গোত্রের পেশাই ছিল ডাকাতি। সেই গোত্রের মানুষ আবু যর (রা.) সত্যের পক্ষে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন এবং নিজের গোত্রকেও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যোদ্ধায় পরিণত করেছেন। রাস্তায় কেউ সম্পদ হারিয়ে ফেললে তা অবশ্যই ফেরত পাওয়া যেত। মানুষ স্বর্ণালঙ্কারের দোকান খোলা রেখেই মসজিদে চলে যেত, কেউ চুরি করত না। মানুষ জীবন গেলেও মিথ্যা বলত না, ওজনে কম দিত না। এই যে শান্তিপূর্ণ অবস্থা কায়েম হয়েছিল এটা কেবল আইন-কানুন দিয়ে হয় নি। মানুষের আত্মায় পরিবর্তন না আনতে পারলে কঠোর আইন দিয়ে চরিত্র ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করা যায় না। যে সমাজের মানুষগুলো কিছুদিন আগেও ছিল চরম অসৎ তাদের আত্মায় এমন পরিবর্তন আনা কী করে সম্ভব হয়েছিল? সেটা হচ্ছে এই সালাত, সওম ইত্যাদি চারিত্রিক প্রশিক্ষণের প্রভাব।
সেই সালাত, সওম তো আজও কম হচ্ছে না, তাহলে এর ফল নেই কেন?
তার প্রথম কারণ - সওম রাখার প্রথম শর্ত হচ্ছে তাকে মো’মেন হতে হবে। এই আদেশ মো’মেনের প্রতি। যে জাতি মো’মেন নয় তারা হাজার সওম পালন করলেও তা কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না। কিন্তু এই জাতি মো’মেন না। আল্লাহ বলেছেন, তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও রাসুলের উপর ঈমান আনে, কোনো সন্দেহ পোষণ করে না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ মো’মেন (সুরা হুজরাত ১৫)। এই সংজ্ঞা যে পূর্ণ করবে সে মো’মেন। আমরা সংজ্ঞায় দুটি বিষয় পেলাম।
এক, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মেনে নেওয়া। যে বিষয়ে আল্লাহ ও রসুলের কোনো হুকুম-বিধান, আদেশ-নিষেধ আছে সেখানে আর কারো হুকুম মানা যাবে না - এই কথার উপর সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত ও দণ্ডায়মান হওয়া। বর্তমানের মুসলিম জনগোষ্ঠী আল্লাহর হুকুমের পরিবর্তে পাশ্চাত্য সভ্যতার হুকুম বিধানকেই তাদের জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনে গ্রহণ করে নিয়েছে। সুতরাং তারা তওহীদে নেই। তারা মোমেন হওয়ার প্রথম শর্তটি পূরণ করেনি।
দুই, তওহীদে আসার পর আল্লাহর এই হুকুম-বিধানকে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক সংগ্রাম (জেহাদ) করতে হবে। তার জীবন-সম্পদ মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করতে হবে। এই মো’মেনের জন্যই হলো সওম, সালাহ, হজ্ব সবকিছু। এই জাতি এই সংজ্ঞার আলোকে মো’মেন নয়। তারা দ্বিতীয় শর্তটিও পূরণ করছে না।
সওমের কোনো প্রভাব সমাজে কেন পড়ছে না তার দ্বিতীয় কারণ হলো, জাতির মধ্যে তাকওয়া, সত্যমিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বোধের সৃষ্টি করা হয়নি। আজকে অন্যান্য জাতির কথা বাদই দিলাম আমাদের মুসলমানদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধের কোনো চিহ্ন নেই। স্বার্থই হয়ে দাঁড়িয়েছে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড। এ বিষয়গুলো আজকে আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে, ভাবতে হবে। ভাবতে হবে এই জন্য যে আমরা মুসলমান ১৮০ কোটি। একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম দেশগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমরা জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদোপম মসজিদ বানাচ্ছি, আমাদের সওম পালনকারীর (রোজাদার) কোনো অভাব নাই, হাজির হজ্বের কমতি নেই, নামাজের কোনো অভাব নাই। কিন্তু ন্যায় অন্যায় বোধ এ জাতির মধ্যে নেই। এতেই বোঝা যায় আমাদের সালাত-সওমসহ অন্যান্য আমল কতটুকু গৃহীত হচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বে রমজানের মাস আসতে না আসতেই দামি দামি পোশাক কেনা শুরু হয়। কথা ছিল এ মাসে আমি পোশাক কিনব গরীব মানুষের জন্য, সে হিন্দু হোক বা মুসলিম। কিন্তু কোথায় কী? যেখানে ইরাক-সিরিয়ার মুসলমানরা উদ্বাস্তু হয়ে অভাবের তাড়নায় ইউরোপের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে সেখানে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে চলে ইফতার আর ঈদের নামে খাদ্য ও সম্পদের বিপুল অপচয়। সওম তাদেরকে কোনো সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, কোনো সহমর্মিতাবোধ শিক্ষা দিচ্ছে না। এভাবেই তাদের সওম তার প্রকৃত সার্থকতা না পেয়ে উপবাসে পর্যবসিত হচ্ছে। এভাবেই রসুলাল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যে পরিণত হচ্ছে।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইমেইল: mdriazulhsn@gmail.com, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫]