Date: April 30, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / জাতীয় / সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ৩৩ জনের প্রাণহানি - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ৩৩ জনের প্রাণহানি

October 26, 2022 09:17:10 PM   জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ৩৩ জনের প্রাণহানি

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আঘাত হানার পর সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। গাছ ভেঙে পড়ে, দেয়াল ধসে এবং পানিতে ডুবে গতকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেশের ১৪ জেলায় ৩৩ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।
ভারি বর্ষণ আর স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সঙ্গী করে গত সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণ শুরু হয় উপকূলের জেলাগুলোতে। সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর আসতে থাকে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বহু এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায়। এখনো পর্যন্ত ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউয়ে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শ্রমিকদের সবার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠী এলাকায়। দ্বীপ জেলা ভোলায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ভোলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড়ের দমকা হাওয়ায় গাছের চাপায় প্রাণ যায় বিবি খাদিজা (৬৮) নামের এক নারীর। চরফ্যাশন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় মোটরসাইকেলে করে দু’জন যাওয়ার পথে গাছের ডাল পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. মাইনুদ্দিন (৪৫)। ভোলা সদর উপজেলার চেউয়াখালী গ্রামের মফিজুল ইসলাম (৭০) ঘরচাপায় এবং লালমোহন উপজেলার ফাতেমাবাদ গ্রামের ফরিদুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (২৫) পানিতে ডুবে মারা যান।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের দুই কনস্টেবল ও এক আসামি নিহত হয়েছেন। মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল আমীন বলেন, জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ সদস্যরা দুই আসামির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মাইক্রোবাসটি রাত সাড়ে আটটার দিকে গোলাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এতে দুই পুলিশ সদস্য কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল এবং আসামি লালন নিহত হন। ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকে তলিয়ে যাওয়া আইপিএস সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টে মারা যান টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া এলাকার শরীফ ফকির। 
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা হেসাখাল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় সোমবার রাতে ঘরের ওপর গাছ পড়লে এক পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন। নাঙ্গলকোট থানার ওসি ফারুক হোসেন বলেন, নিহত তিনজন হলেন নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার ও তাদের চার বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে সোমবার রাতে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা যান মর্জিনা বেগম (৪০) নামের এক নারী। তার বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামে। বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকায় একটি ঘরের চালে গাছ পড়লে ওই ঘরে থাকা আমেনা খাতুন নামের এক নারী মারা যান। সোনাখালী এলাকার সমাজকর্মী এনামুল হক ওরফে শাহীন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে নিহত আমেনা খাতুনের বয়স ১০০ বছরের বেশি। ওই নারী রাত আটটার দিতে ঘরের ভেতর খাবার খাচ্ছিলেন। ঝড়ের সময় একটি গাছ তার ঘরের ওপর পড়ে। এ সময় চাপা পড়ে তিনি মারা যান।
প্রবল ঢেউয়ে সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত নয়টার দিকে জেলা সদরের সয়দা ইউনিয়নের মোহনপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত দুজন হলেন মোহনপুর গ্রামের খোকন হোসেনের স্ত্রী ও শিশুসন্তান। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম জানা যায়নি। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গাছচাপায় দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি মুহাম্মদ আবুল মনসুর বলেন, এই দুই নারী হলেন উপজেলার পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়ির চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮)। ঝড়ের সময় রান্নাঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা গ্রামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সানজিদ আফ্রিদি নামের শিশুটির বয়স ১১ মাস। সানজিদ ওই গ্রামের বাসিন্দা আইনজীবী মো. আবদুল্লাহর ছেলে। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। শরীয়তপুরে গাছের নিচে চাপা পড়ে সাফিয়া বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি জেলার জাজিরা উপজেলার সিডারচর এলাকার হালান মুসল্লির স্ত্রী। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, সাফিয়ার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে মৃত্যুটা এড়ানো যেত।
কক্সবাজারের টেকনাফে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে ডেক থেকে পড়ে শৌমিং (৭১) নামের একজনের মৃত্যু হয়। তিনি মিয়ানমারে নাগরিক। তিনি ওই জাহাজের বাবুর্চি ছিলেন। এ ছাড়া ঝড়ের সময় নিখোঁজ এক শিশুর লাশ পরে টেকনাফ পৌরসভার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। সোহেনা (৯) নামের শিশুটি টেকনাফ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলমের মেয়ে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান দুজনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। পটুয়াখালী সদর উপজেলার প্রতাপপুর খেয়াঘাট এলাকায় লোহালিয়া নদীতে ইটবোঝাই ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন ট্রলারের শ্রমিক নুরুল ইসলাম (৪৫)। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পটুয়াখালী নদী ফায়ার স্টেশনের ডুবুরিরা তাঁর লাশ উদ্ধার করেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ট্রলারটি নোঙর করতে গেলে সেটি ডুবে যায়। ফায়ার স্টেশনের লিডার মজিবুর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ঘরচাপায় আনিসুর রহমান (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কাপাসিয়ার ইউএনও এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় মাটির ঘর ধসে গিয়ে পাশের টিনের ঘরকে চাপা দেয়। এতে ওই ঘরে থাকা শিশু আনিসুরের মৃত্যু হয়। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবের সময় বসত ঘরে গাছ ভেঙে পড়লে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়। লৌহজং থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল তায়েবীর বলেন, নিহত দুজন হলেন উপজেলার কনকসার এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম (২৮) ও তাঁর মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (৩)। 
ক্ষয়ক্ষতি: ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের ৪১৯টি  ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ইউনিয়নে আনুমানিক ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৬ হাজার হেক্টর ফসলের জমি নষ্ট হয়েছে এবং ১ হাজার মৎস্য ঘের ভেসে গেছে।  প্রাথমিক এই ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।  প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের তরফ থেকে ঘর মেরামতের জন্য টিন দেওয়া হবে। আর যাদের মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা সুদমুক্ত ঋণ পাবেন। ঘূর্ণিঝড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোট নয়জনের মৃত্যুর তথ্য দেন প্রতিমন্ত্রী, যদিও স্থানীয় কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য হিসাব করলে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়।  দুর্যোগে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন। তিনি জানান, দেশের ৬ হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০ লাখ লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন ঝড়ের সময়। ঝড় কেটে যাওয়ার পর তারা সবাই আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়েছেন।
লণ্ডভণ্ড কক্সবাজার সৈকত: ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে উত্তাল ঢেউয়ে লণ্ডভণ্ড হয়েছে কক্সবাজার সৈকত। সৈকতের সৌন্দর্য হারিয়ে পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। এছাড়া টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের দুই পাশের অংশে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। সৈকতের ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, “ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে সৈকতে। ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট, তলিয়ে গেছে জিও ব্যাগ। সৈকতের শৈবাল থেকে কলাতলী পর্যন্ত ব্যাপক ভাঙন হয়েছে বালিয়াড়ির। একই সঙ্গে ময়লায় সয়লাব সাগরপাড়।” মহিউদ্দিন আহমেদ নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, “আট ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়ে আঘাত করেছে সৈকত এলাকায়। সৈকতের দরিয়ানগর এলাকায় বেশকিছু ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে ঘরের আসবাবপত্র।”
এদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং পরবর্তী সৈকত দেখে হতাশ পর্যটকেরা। বালিয়াড়ি ও জিও ব্যাগে দাঁড়িয়ে উত্তাল সাগড় দেখছেন তারা। অনেকে ছবি তলে ক্যামেরায় বন্দি করছেন। তবে ভয়ে কেউ নামছেন না সমুদ্রস্নানে। ‘সি সেইফ’ লাইফ গার্ডের ইনচার্জ মোহাম্মদ সিরু আলম বলেন, সাগর উত্তাল থাকায় এখনও পর্যটকদের নামার অনুমতি নেই। মাইকিং করে পর্যটকদের অনুরোধ করা হচ্ছে নির্দেশনা মেনে চলতে।