
শীতকাল মানেই খেজুর রসের স্বাদ, যা নানা ধরনের মুখরোচক পিঠা-পায়েস তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান। এক সময় শীতের আগমনে দক্ষিণাঞ্চলে খেজুর রস সংগ্রহকারীদের ব্যস্ততা ছিল তুঙ্গে। গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে এ সময় চলত খেজুর রস সংগ্রহের প্রতিযোগিতা। তবে, কালের বিবর্তনে আজ আর সেই ঐতিহ্য ও কর্মব্যস্ততা দেখা যায় না।
দক্ষিণাঞ্চলে খেজুর রস সংগ্রহকারীদের মধ্যে এখন আগের মতো তাড়া বা প্রতিযোগিতা নেই। এক সময়ের জমজমাট খেজুর রস সংগ্রহের দিনগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শরীয়তপুর জেলা বিশেষত শ্রীনগর, সখিপুর ও জাজিরা উপজেলায় এক সময় শীতের শুরুতেই দেখা যেত খেজুর গাছ কাটার প্রতিযোগিতা। গাছিরা নিজের-পরের গাছ কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন, কারণ শীতের মৌসুমে খেজুর রস ছিল নবান্নের একটি অপরিহার্য খাদ্য। কিন্তু আজকাল সেই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।
প্রতিটি গ্রামের খেজুর গাছ ছিল খেজুর রস সংগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু আজ সেই গাছ সংখ্যা খুবই কমে গেছে। কেবল কিছু গাছি এখনও খেজুর গাছ কাটার কাজ করছেন, তবে তা একসময়কার মতো ব্যাপক নয়।
খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া এখনও একই রকম, তবে আধুনিক প্রযুক্তির বদলে এখনও পুরনো পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। খেজুর গাছের ডগা একপাশ থেকে কাটিয়ে শুকানো হয়, তারপর বাঁশের খিল ও চুঙ্গির মাধ্যমে রস সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে ৪ দিন রস বের করা হয় এবং বাকি ৩ দিন গাছ শুকানো হয়। খেজুর রস থেকে গুড়, পাটালিগুড় সহ নানা ধরনের গুড় তৈরি করা হত, যা গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে এই ঐতিহ্যও কমে যাচ্ছে।
শরীয়তপুর জেলার সখিপুর থানার গাছিয়া মো. সাইফুল দেশেরপত্রকে জানান, “আগের মতো এখন আর খেজুর গাছ পাওয়া যায় না। কিছু গাছ পাওয়া গেলেও মালিকের অনুমতি না পেলে আমি গাছ কাটতে পারি না। গাছের মালিককে সপ্তাহে তিন দিন রস দিয়ে বাকি চার দিন বাজারে বিক্রি করে যে টাকা পাই, তাতে পরিশ্রমের মূল্য হয় না। তবে, মৌসুমি রসের স্বাদ পেতে আমি এই পেশাকে ছাড়তে পারিনি।” সাইফুল আরও বলেন, “এ বছর আমি ৫০টি গাছ প্রস্তুত করেছি, প্রতিটি গাছ থেকে ২ থেকে ৫ কেজি রস পাব বলে আশা করছি।”
তিনি আরও বলেন, “এই পুরনো পেশা ধরে রাখার জন্য, আমি খেজুর রস সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তবে, আজকাল অনেকেই গাছ কাটেন না এবং খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।”
এদিকে, শরীয়তপুরের এক গাছিয়া দেশেরপত্রকে জানান, “প্রতিবছর শীতের শুরুতেই খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। রসের চাহিদা আকাশচুম্বী হওয়ায়, বৃদ্ধ বয়সেও আমি এই পেশা ছাড়তে পারিনি।” তবে তিনি জানালেন, গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং অনেকেই এখন আর গাছ কাটেন না, যা এই ঐতিহ্যবাহী পেশার জন্য খুবই হতাশাজনক।
খেজুর রস উৎপাদন ও সংগ্রহের পুরনো পদ্ধতিগুলি যদি অব্যাহত না থাকে, তবে এই ঐতিহ্য এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ধরনের পিঠা-পায়েসও হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাই, স্থানীয়দের মধ্যে এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।