Date: April 29, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সংগঠন সংবাদ / ইসলামে দাসত্বব্যবস্থা নেই! - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

ইসলামে দাসত্বব্যবস্থা নেই!

May 02, 2023 11:50:38 AM   বিশেষ প্রতিবেদক
ইসলামে দাসত্বব্যবস্থা নেই!

আদিবা ইসলাম:
ইসলাম সম্পর্কে ইসলামবিদ্বেষীরা যে অপবাদগুলো আরোপ করে থাকে তারমধ্যে অন্যতম অপবাদ হচ্ছে ইসলাম বর্বর দাসত্বপ্রথাকে উৎসাহিত করে, ইসলাম এসে দাসত্বব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করেছে, যুদ্ধবন্দীদের দাসদাসীরূপে ব্যবহার করেছে ইত্যাদি। বিগত কয়েক শতাব্দি ধরে এই ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠীটি এভাবেই একচেটিয়াভাবে ইসলামকে জবরদস্তিমূলক, দাসব্যবস্থাকে উৎসাহপ্রদানকারী একটি ধর্ম হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে আসছে। এই কাজটি করার জন্য তারা ইসলামের বিকৃত ইতিহাস নেওয়ার পাশাপাশি সুবিধামত কোর’আনের কিছু আয়াতের ভগ্নাংশ ব্যবহার করেছে। কোর’আনের ভুল অনুবাদ করে, অপব্যাখ্যা দিয়ে, বলা যায় একপ্রকার কারচুপি করেই তারা ইসলামকে দাসব্যবসাসৃষ্টিকারী একটি ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। কিন্তু ইসলাম যে প্রকৃতপক্ষে দাসত্বব্যবস্থা সৃষ্টি করেনি বরং দাসব্যবস্থার মত অমানবিক রীতি-রেওয়াজকে বিলুপ্ত করার জন্যই যে ইসলামের আগমন হয়েছে - এই মহাসত্যটি আমাদের অনেকের কাছেই পরিষ্কার না। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে করা ইসলাম সম্পর্কে এই ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠীটির আরোপিত অপবাদ এবং ভুল ব্যাখ্যার কোন যৌক্তিক জবাব আমাদের আলেম-ওলামা শ্রেণিটি দিতে পারেনি। বরং ইসলামবিদ্বেষীদের আরোপিত যুক্তির খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এ কথা স্বীকার করে বসেন যে, ‘ইসলামে দাসপ্রথা আছে, কিন্তু ইসলাম দাসদের বহু সুযোগ-সুবিধাও দিয়েছে।’ এভাবে দুর্বল যুক্তি উপস্থাপন করে তারা ইসলামবিদ্বেষীদের হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে চেয়েছেন। এমনকি অনেক বক্তা দাসব্যবস্থার প্রয়োজনীয়ওতাও তুলে ধরেন। অথচ কোর’আনে দাসপ্রথার সমর্থন দূরে থাক, দাসমুক্ত করার জন্য বহু আয়াতে তাগাদা প্রদান করা হয়েছে। অনেকে বলেন যে, ইসলামে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসী হিসাবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এটাও সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আল্লাহ সুরা মোহাম্মদের ৪ নম্বর আয়াতে যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে বলেন, ‘যখন তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দানে মার, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত করে ফেল, তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ লও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করবে! একথা শুনলে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান।’ এ আয়াতে যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে আল্লাহ দুটো বিকল্প দিলেন। হয় তাদেরকে অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে হবে, অর্থাৎ এমনিতেই মুক্ত করে দিতে হবে; নতুবা মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দিতে হবে। এখানে দাস-দাসী বানিয়ে রাখার কোনো সুযোগ আল্লাহ রাখেননি। 
ইসলামের দাসত্বব্যবস্থার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার পূর্বে এখানে দাসব্যবসার উৎপত্তি নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। একদম আদিমকাল থেকে পৃথিবীতে দাসব্যবসার প্রচলন ছিল। কয়েক হাজার বছর পূর্বের প্রাচীন ব্যাবিলোনিয়া, মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বিস্তারে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম ও ৮ম শতকে প্রাচীন গ্রিস, রোমেও একচেটিয়া দাসত্বব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ইসলামবিদ্বেষী লেখক এম.এ খান তার ‘ইসলামিক জিহাদ’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, প্রাচীন গ্রিসের নগরাষ্ট্র এথেন্সে এক সময় মাত্র ২১০০ স্বাধীন নাগরিকের বিপরীতে ৪,৬০,০০ ক্রীতদাস ছিল। প্রাচীন রোম প্রজাতন্ত্র ও রোম সাম্রাজের প্রাথমিক যুগে জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছিল ক্রীতদাস। প্রাচীন চীনে সম্রাটরা শত শত এমনকি হাজার হাজার ক্রীতদাস তাদের ভোগবিলাস এবং সেবার কাছে নিয়োজিত থাকত। অধিকাংশ ক্রীতদাস ছিল দাসী মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী। মধ্যযুগে ইউরোপে দাসপ্রথা ছিল ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত এবং অনুমোদিত। ৩৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট ফ্লাভিয়াস গ্রাটিয়ানাসের শাসনাকালে দাসদের বিষয়ে এই অনুশাসন জারি করেন যে, ক্রীতদাস তার মালিকের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ করলে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। এভাবে প্রাচীনকাল থেকেই কখনো দুর্বল গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করে বিজয়ী গোষ্ঠীটি পরাজিত গোষ্ঠীটিকে দাস বানিয়ে কিংবা দারিদ্রপীড়িত দেশগুলো থেকে মানুষ পাচার করে দিয়ে মানুষকে বেচাকেনার এই বাণিজ্য চালাত। যার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বংশপরম্পরায় সেই মানুষকে কোন একজন ব্যক্তির স্থায়ী সম্পত্তিতে পরিণত হত। 
দাসত্বের শিকলে বন্দি সেই সব দাসদের অবস্থা কতটা করুণ এবং বিভীষিকাময় ছিল, তা লিখতে গেলে হাজার হাজার পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। তাই সেদিকে যাচ্ছি না। শুধু এতটুকু বলতে পারি যে, দাসদের মানুষ হিসেবে নূন্যতম মৌলিক অধিকার কিংবা বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো তো দূরে থাক, তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের স্বাধীনতাও মালিকের ইচ্ছামর্জির উপরই অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। তাদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হত না, তাদের অবস্থান ছিল পশুর চেয়েও নিচে। 
মূল আলোচনায় ফিরে আসি, আল্লাহর শেষ রসুল (সা.) যখন আরবে আবির্ভূত হলেন তখন আরবেরও একটি বড় ব্যবসা ছিল দাস ব্যবসা। আরবের বানিজ্য ব্যাবস্থার বিরাট একটি অংশ ছিল দাস ব্যাবসা। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বন্দী করে, জাহাজ ভর্তি করে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দাসদেরকে বিক্রি করা হত। কেবল আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গই নয়, যুদ্ধবন্দীদেরকেও দাসদাসী হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হতো হরদম। যেহেতু বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য কাফেলাকে মক্কার উপর দিয়ে যেতে হত তাই মক্কাও ছিল দাসব্যবসার একটি বড় কেন্দ্র। সেখানেও চলত রমরমা দাসব্যবসা। ইসলাম আগমনের পর রসুলাল্লাহ এসে এই দাসত্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান নিলেন। তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, বৈষম্য, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে, দাসত্বব্যবস্থাকে নির্মূল করতে শক্ত অবস্থান নিলেন। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা একটি সামাজিক প্রথাকে একদিনে নির্মূল করা সম্ভব ছিল না। বংশ পরম্পরায় গড়ে ওঠা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাওয়া দাসত্ববৃত্তির মানসিকতা দূর করা, দাসদের অধিকার নিশ্চিত করা, তাদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা, দাস-মালিকের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটানো এত সহজ ছিল না। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আরব সমাজ অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞতা, ববরর্তা, কুসংস্কারে একদমই নিমজ্জিত। এমন একটি সমাজ থেকে দাসত্বব্যবস্থা বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, দাসত্বব্যবস্থার মূল উৎপাটন করার অর্থ ছিল বাস্তবিক অর্থে পুরো সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
তাই দাসত্বপ্রথা বিলুপ্তির প্রথম পদক্ষেপটা রসুল (সা.) নিজের ঘর থেকেই নিলেন। উম্মুল মোমেনীন আম্মা খাদিজা (রা.) রসুলাল্লাহর সাথে বিয়ের পর তাঁর সেবা করার জন্য যখন দাস যায়েদ ইবনে হারিসাকে (রা.) নিয়োগ করলেন তখন রসুলাল্লাহ (সা.) সঙ্গে সঙ্গে  যায়েদকে আযাদ করে দিলেন। কিন্তু দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েও যায়েদ (রা.) রসুলাল্লাহর সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। ফলে যায়েদের (রা.) বাবা চাচারা যখন তাকে খুঁজতে খুঁজতে মহানবীর (দ.) কাছে আসলেন তখন যায়েদ (রা.) তাদের সাথে গেলেন না। মোহাম্মদ (দ.) বললেন, ‘সে তো এখন মুক্ত, আপনারা তাকে নিয়ে যেতে পারেন।’ কিন্তু যায়েদ (রা.) বললেন উল্টো কথা। তিনি বাবা চাচা কে বললেন, ‘আপনারা ফিরে যান, আমি যাব না। আমি তাঁর কাছেই থাকতে চাই।’ তাহলে দাসের সাথে রসুলাল্লাহর এ কেমন আচরণ ছিল যেখানে দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পরও একজন দাস সেচ্ছায় রসুলাল্লাহর সঙ্গকেই জীবনের পরম আরাধ্য বলে মনে করেছিল! এটা সহজেই অনুমেয় যে যায়েদ (রা.) এর সাথে রসুলাল্লাহর আচরণ কোনো দাসের আচরণ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সাথে রসুলাল্লাহর আচরণ ছিল সন্তানতুল্য। তাই তিনি মহানবীর (দ.) আচরণে ও ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন এবং পরবর্তীতে নবী হিসাবে তাঁর প্রতি ঈমান এতই নিখাঁদ ছিল যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহানবীর (স.) সাথে ছায়ার মত অনুবর্তী ছিলেন। এমনকি মহানবীর বিপ্লবী আন্দলোনে শরিক হয়ে যুদ্ধের ময়দানে নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন। 
দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) এর শাসনামলের যে ঘটনা সকলেরই জানা। উমর (রা.) রাষ্ট্রীয় কাজে জেরুজালেম যাচ্ছিলেন। মদীনা থেকে জেরুজালেম প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার পথ যার অধিকাংশই ছিল মরুভূমি। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় ওমরের (রা.) সঙ্গী ছিলেন একজন ভৃত্য যাকে ইতিহাসে দাস বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ওমর (রা.) তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করেছিলেন সেটা কি উপরে বলে আসা দাসত্বব্যবস্থার সঙ্গে যায়? তিনি পুরোটা পথে তাঁর ভৃত্যের সাথে পালাক্রমে উটে বসলেন এবং কিছু পথ ভৃত্যকে উটে বসিয়ে উটের রশি ধরে এগিয়ে চললেন। ইসলাম যে দাসকে ভাইয়ের মর্যাদা প্রদান করেছে তা বোঝার জন্য এই দুটো ঘটনাই যথেষ্ট।
ইসলাম স্বেচ্ছাশ্রমে বিশ্বাসী, দাসত্ব নির্মূলকারী। কিন্তু রসুলাল্লাহ চলে যাওয়ার ৬০/৭০ বছর পর যখন ইসলামের প্রকৃত আকিদা হারিয়ে উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটি তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভুলে গেল তখন জাতির শাসকরা দুনিয়াময় ন্যায়, সুবিচার, শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব বাদ দিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার ও ভোগ-বিলাসিতায় ডুবে গেল। জাতির শাসকরা নিজেদের আমোদ-প্রমোদ, বিলাসিতার জন্য আবারও কবর খুঁড়ে জাহেলিয়াতের যুগের দাসত্বপ্রথাকে পুনর্জীবিত করল। যে দাসত্বব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করতে, সকল মানুষের সমান অধিকারকে নিশ্চিত করতে রসুলাল্লাহ (সা.) সারাজীবন সংগ্রাম করে গেলেন, পুরো সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করলেন পরবর্তীতে জাতি লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার পর জাতির মুসলিম পরিচয়ধারী শাসকরা আবারও দাস কেনাবেচা, খোঁজকরণ ইত্যাদির চর্চা শুরু করলেন। সকল মানুষ যে এক পিতামাতার সন্তান সেটা তারা তা ভুলে গেলেন। কিন্তু তারা যেহেতু নাম-পরিচয়ে মুসলিম শাসক তাই তাদের এসব অপকর্মকে ইসলামের আচরণ বলেই ইতিহাসে সাব্যস্ত করা হল, ইসলামের গায়ে দাসত্ব প্রথার কলঙ্ক আরোপ করা হল। কিন্তু এ বিষয়টা স্পষ্ট করা দরকার যে, ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর বিধান ও রসুলাল্লাহর জীবনাদর্শ। পরবর্তীতে মুসলিম নাম ধারণ করে যে যা-ই করবে তার দায় ইসলামের উপর চাপানো যাবে না। ঠিক তেমনিভাবে পথভ্রষ্ট মুসলিম নামধারী শাসকদের দ্বারা দাসত্বব্যবস্থার চর্চার দায়ভার ইসলাম নিবে না।