Date: April 29, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সংগঠন সংবাদ / একজন ক্রীতদাস মো’মেনের সম্মান কাবার উর্ধ্বে! - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

একজন ক্রীতদাস মো’মেনের সম্মান কাবার উর্ধ্বে!

May 02, 2023 11:52:59 AM   জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
একজন ক্রীতদাস মো’মেনের সম্মান কাবার উর্ধ্বে!

এম রহমান:
আল্লাহর রসুল হযরত মোহাম্মদ (স.) রিসালাত পাওয়ার পর একেবারে গোড়ার দিকে যারা তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে হযরত বেলাল (রা.) ছিলেন একজন। ওই সময়ে মক্কার কোরায়েশদের প্রবল বিরোধিতা ও নির্যাতনের মুখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা এবং প্রকাশ্যে তা ঘোষণা দেয়া বা স্বীকার করা ছিল দুঃসাহসের বিষয়। হযরত বেলাল (রা.) এর জন্য বিষয়টি আরো কঠিন ছিল এ কারণে যে, তিনি ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তথাপি মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আজন্ম নির্যাতিত বেলাল (রা.) তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনেন। ‘কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস’ বেলাল কোরায়েশদের ধর্ম অস্বীকার করে ‘মোহাম্মদের ধর্ম’ মেনে নিয়েছে, বিষয়টি যখন জানাজানি হয় তখন তার উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। একের পর এক চাবুকের আঘাত, ক্ষত-বিক্ষত শরীরে কংকর ও বালুময় মরুর পথ ধরে টেনে-হেচড়ে নিয়ে যাওয়া, প্রখর রোদে উত্তপ্ত বালু ও কয়লার উপর শুইয়ে রাখা, বুকের উপর প্রকাণ্ড পাথর চাপা দিয়ে রাখা, এক কথায় নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চটা দেখানো হয়েছিল এই মানুষটির সাথে। তথাপি তিনি ঈমানের পথে ছিলেন অবিচল। নির্যাতনের এক পর্যায়ে হযরত মোহাম্মদ (স.) এর বন্ধু ও প্রিয়তম সাহাবী আবু বকর (রা.) বেলালের মনিবের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে তাঁকে ক্রয় করে নেন এবং আজাদ করে দেন।
হযরত বেলাল (রা.) এর উপর যে পরিমাণ নির্যাতন হয়েছিল তার মূল কারণ, তিনি ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তৎকালীন আরব সমাজে একজন ক্রীতদাসের তুলনা কেবল একটি পশুর সাথেই করা যায়। মানুষ হিসেবে তার কোনো স্বীকৃতি ওই সমাজে ছিল না। অবশ্য আজকের আধুনিক শ্রম ব্যবস্থাতেও একজন শ্রমিককে কতটুকু মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়, আর কতটা ভারবাহী পশু মনে করা হয়, এ ব্যাপারেও প্রশ্ন রয়েছে। যাই হোক, আল্লাহর রসুলের (সা.) অন্যান্য সাহাবীদের তুলনায় হযরত বেলাল (রা.) এর উপর নির্যাতন বেশি হওয়ার কারণ এটিই যে, তিনি ছিলেন আজন্ম ক্রীতদাস। সুতরাং তার নিজের কোনো ইচ্ছা থাকতে পারে না। তার মনিবের চাওয়ার পূর্ণ করাই তার একমাত্র কাজ। হযরত বেলালের (রা.) মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ যখন জানতে পারে, তখন উমাইয়ার কথায় কিন্তু এই বিষয়টি ওঠে আসে, “তোর মা ছিল আমার দাসী, তোর বাবা ছিল আমার দাস, তুইও জন্ম থেকে আমার দাস, তোর কিভাবে সাহস হয়, আমাদের দেবতাকে অস্বীকার করিস?” 
অথচ সেই একই মানুষ যখন ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন তখন আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা তাকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে বসিয়েছিলেন। ইসলাম হযরত বেলালকে (রা.) কতটা সম্মানের জায়গায় নিয়ে এসেছিল তা উপলব্ধি করতে হলে আমরা কিছু ঘটনা ও বিষয়াবলীর উল্লেখ করছি। 
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে হিজরী অষ্টম বর্ষে, যে দিন আল্লাহর রসুল (স.) মক্কা নগরী জয় করেন। মক্কা জয় করার পর তিনি হযরত বেলাল (রা.) কে ডেকে বলেন, “বেলাল! কাবার উপর ওঠো। আযান দাও।” রসুলের নির্দেশে বেলাল (রা.) কাবা ঘরের উপরে উঠলেন এবং আযান দিলেন। মনে রাখতে হবে, এটা অন্য কোনো ঘর নয়, বরং কাবা! এটা সেই কাবা যে কাবা ছিল কোরায়েশ তথা মক্কাবাসীর কাছে তাদের সম্মানের প্রতীক, তাদের আভিজাত্যের প্রতীক। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহর রসুল অহংকারী কোরায়েশদের সমস্ত অহংকার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেন। শুধু কোরায়েশদের কাছে নয়, মুসলিম উম্মাহর কাছেও এই কাবা পৃথিবীর জমিনে পবিত্রতম স্থান হিসেবে বিবেচিত। সেই কাবা বেলালের পায়ের তলায়! এই ঘটনা প্রমাণ করে, একজন মোমেন বান্দা, সে কালো হোক আর ক্রীতদাস হোক, তার সম্মান আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কাছে কাবারও উর্ধে।
ওই একদিনের ঘটনায় নয়, বরং হযরত বেলালের জীবনে এরকম বহু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যা একজন আজন্ম ক্রীতদাসের জন্য ইসলামী জীবনব্যবস্থা ব্যতীত অন্য কোনো সমাজে অকল্পনীয়। যেমন- মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আল্লাহর রসুল (সা.) বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্ব প্রদান করেন বেলাল (রা.) এর হাতে। অর্থাৎ তিনি ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম হিসাবরক্ষক। বর্তমান পরিভাষা ব্যবহার করলে আমরা বলতে পারি, তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম অর্থমন্ত্রী!
মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহর রসুল (স.) কাবা ঘরের চাবি তুলে দিয়েছিলেন হযরত বেলাল (রা.) এর হাতে। তাঁর কাঁধেই ন্যস্ত হয়েছিল কাবা ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, দেব-দেবীর প্রতিমা মুক্ত করে সেটাকে পবিত্র করার মূল দায়িত্ব।
জন্মগতভাবে একজন হাবশী ক্রীতদাস হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরবর্তীতে বিবাহ করেছিলেন আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) এর কন্যার সাথে হযরত বেলাল (রা.) এর বিবাহ দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহর রসুল (সা.)।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে হযরত বেলাল (রা.) দামেস্ক তথা সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন। 
যে ক্রীতদাসের কথা বলার অধিকার ছিল না, নিজের ব্যক্তিগত বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ছিল না, মনিবের মুখে মুখে কথা বলাকে বিবেচনা করা হতো ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধা হিসেবে, সেই ক্রীতদাসকে ইসলাম কোন্ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল! এটাই ইসলামের সৌন্দর্য, এখানেই ইসলামের মাহাত্ম্য। যারা ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্যকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যারা ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে বর্তমান যুগে অচল ও অকার্যকর হিসেবে সাব্যস্ত করতে চান, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তাদের সামনে অনুপস্থিত। আর এ কারণেই তথাকথিত “নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ” হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাধারণ দিন-মজুর ও শ্রমিক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী ও সমাজপতিরা মানবতার মুক্তি ও শ্রমিকের অধিকার খুঁজে বেড়ান পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার মধ্যে। অবশ্য এই ব্যর্থতার দায় বহুলাংশে বর্তায় সেই ধর্মজীবী শ্রেণিটির উপর, যারা নিজেদের স্বার্থে ধর্মের প্রকৃত রূপটিকে আড়াল করে একটি বিকৃত চেহারা মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]