
ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা, মানিকগঞ্জ:
একের পর এক লাশ উদ্ধারে চরম উৎকন্ঠা ও আতংক ছড়িয়ে পরেছে মানিকগঞ্জের ঘিওরবাসীর মাঝে। শান্ত পরিবেশের হঠাৎ এমন ছন্দ পতনে ঘিওর এখন পরিনত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে। গত ৩ মাসের ব্যবধানে হত্যাকান্ডে আট জন নিহত, তিনটি আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার নিহত চার জনের মর্মান্তিক মৃত্যু, দুটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। এছাড়াও অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে রয়েছেন অজানা ভয়ে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্মরণকালের মধ্যে ঘিওরে এত খুনাখুনি, দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা আর লাশ উদ্ধারের ঘটনা এবারই প্রথম। এসব কারণে চাপে রয়েছেন পুলিশও। তবে পুলিশের দাবী, এগুলো বিক্ষিপ্ত ও পারিবারিক ঘটনা। এতে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ও আতঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই।
গত শনিবার আব্দুল কুদ্দুস (৪০) নামের এক আনসার ভিডিপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। উপজেলা আনসার ও ভিডিপির কার্যালয়ের সামনে থেকে বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মো. শাহিনুর ইসলাম নামের (২৮) আরেক আনসার সদস্যকে আটক করে পুলিশ।
গত বৃহস্পতিবার (২২ শে জুলাই) বিয়ের দুই মাসের মাথায় নববধুর গলা কাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্ত্রীকে জবাই করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে জেলার ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের শোলধারা গ্রামে। ঘাতক স্বামী রূপক পেশায় মুহুরী, সে মানিকগঞ্জ জজ কোর্টে কাজ করতেন। এমন ঘটনায় পুরো বানিয়াজুরী ইউনিয়নবাসী আতংকিত ও স্তম্ভিত। এমন নৃশংস্য হত্যাকান্ডে বিগত দুই দশকেও দেখেনি এলাকাবাসী।
বৃহস্পতিবার নৌভ্রমণে কলেজ শিক্ষার্থীর নিখোঁজের ২৮ ঘন্টা পর রক্তাত্ত লাশ তরা কালীগঙ্গা সেতুর পাদদেশ থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত বর্ষন ইসলাম দেবেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। র্যাব-৪ এর মানিকগঞ্জ অঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আরিফ হোসেন জানান, বর্ষণের মাথা ও গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মৃত্যুর কারন পোষ্ট মর্টেম ও তদন্তের পরে জানা যাবে।
গত মঙ্গলবার রাতে সেলফি বাসের চাপায় নিহত হয় দুই শিক্ষার্থী বন্ধূ। ঢাকা আরিচা মহাসড়কের ঘিওরের তরা ব্রীজ এলাকায় বেপরোয়া বাস মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু আশিকুর ও জুয়েলকে পিষে দেয়। বিভৎস্য এমন মৃত্যুতে পুরো এলঅকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানের মোটরসাইকেল চলাচলে আতংকিত হয়ে পরে।
এর একদিন পরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঘিওর উপজেলার পুখুরিয়া এলকায় যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রাক চালক মো: মারুফ মর্মান্তিক মৃত্যু বরণ করেন। আহত হন আরও ১২ জন।
৭ জুলাই রাতে হেলিপ্যাড নামক স্থানে এক রিকশা চালকের হাত পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগে নিহতের ছোট ছেলে মোঃ শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ঘিওর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। কিন্তু পুলিশ এই হত্যাকান্ডের কোন কূল-কিনার করতে পারেনি। গ্রেফতারও করতে পারেনি কোন আসামিকে।
২৫ শে জুন ঘিওরের ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২২ শে জুন স্ত্রীকে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে তার লাশ কেটে ধলেশ্বরী নদীতে ভাসেয়ে দেয় পাষন্ড স্বামী। এ দুটি ঘটনায় ধলেশ্বরী নদীপাড়ের মানুষজনের মাঝে আতংক দেখা দেয়।
১৯ ই জুন ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষনের অভিযোগে মেহেরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি আটক হয়। তার বাড়ি পাবনা জেলায়। সে দিনমজুরের কাজ করতে এসে এমন পাশবিক কাজ করে। এছাড়াও যশোরের বাঘারপাড়া থেকে দুইজন হত্যা মামলার আসামি শ্রমিক সেজে ঘিওর থেকে গ্রেফতার হয়। এই দুটি ঘটনায় কৃষি নির্ভর পরিবারে শ্রমিক ভাড়া করতে ভয় পাচ্ছেন এলাকাবাসী।
২ জুন ঘিওর উপজেলার শ্রীধরনগর মোড় এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আব্দুর রউফ (১৬) নামে এক কিশোরের মরমান্তিক মুত্যু হয়। ২৭ শে মে নতুন ব্রীজ এলাকায় মোটর সাইকেল আরোহী অপর কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় এলাকায় শোক বিরাজ করছে।
২৩ মে বিদ্যালয়ের যাওয়ার পথে এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার দায়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় সংঘর্র্ষের ঘটনা ঘটে। খোন্দকার আমিনুর রহমান ওরফে সোহাগ নামের বখাটে যুবককে এক মাসের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই দিনে গরু ব্যবসায়ীদের মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। বানিয়াজুরী বাসষ্ট্যান্ডে স্থানীয় জনতা জড়ো হয়ে শেষ রক্ষা পান ব্যবসায়ীদ্বয়।
১৪ ই মে বসতবাড়ি লিখে না দেয়ায় জন্মদাত্রী মাকে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়েছে এক পাষন্ড ছেলে। উপজেলার চর বাইলজুরী গ্রামের এমন ঘটনায় পুরো এলাকায় ধিক্কার পরে যায়।
১১ ই মে মহাসড়কের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ৩০ যাত্রী মারাত্মক আহত হন। বেশিরভাগ যাত্রীই ঘিওরের বিভিন্ন গ্রামে। পুঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেকে।
গত ৮ মে ঘটে সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনা। স্ত্রী ও দুই কন্যাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করেছেন এক ব্যক্তি। উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের আঙ্গারপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতক রুবেল পাশের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাঁচুরিয়া এলাকায় আত্মহত্যার জন্য শুয়ে থাকলে স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশে সোপর্দ করেন।
এসব হত্যা, লাশ উদ্ধারের ঘটনায় উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নেই বিরাজ করছে অজানা আতংক। গৃহবধূ ফিরোজা বেগম জানান, প্রতিদিনই সকাল হলে একটা না একটা খুনের কথা শুনি। এসব ঘটনায় ভয় তো করবেই।
আঙ্গারপাড়া গ্রামের মোসলেম মিয়া বলেন, জবাই করা তিনটি লাশ দেখে এক মাস ঠিকমতো খেতে পারিনি। এখনো এ এলাকার মানুষ সন্ধ্যার পর ভয়ে বাইরে বেরোতে চায়না।
বানিয়াজুরী ইউনিযন পরিষদ চেয়ারম্যন এসআর আনসারী বিল্টু বলেন, আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে। আমার ইউনিয়নে স্ত্রীকে নৃমংস্যভাবে খুনের এমন ঘটনা বিগত ২০ বছরেও ঘটেনি।
ঘিওরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আহমদ আলী বলেন, ঘিওরে গত কয়েক মাসে খুনোখুনির ঘটনায় মানুষ আতংকিত। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরাতো ভয় পাচ্ছে মানুষজন।
শিবালয় সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরজাহান লাবনী বলেন, এগুলো বিক্ষিপ্ত ও পারিবারিক ঘটনা। প্রতিটি ঘটনার সময় উপযোগী তদন্ত, আসামি আটক ও বিচারের আওতায় আনার জন্য তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এতে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ও আতঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই। সাম্প্রতিক ঘটনায় পুলিশকে আরো তৎপরতার সাথে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।