Date: May 01, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সারাদেশ / কী ঘটেছিল ময়মনসিংহের ইশ্বরগঞ্জে? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

কী ঘটেছিল ময়মনসিংহের ইশ্বরগঞ্জে?

April 27, 2023 10:06:46 PM   নিজস্ব প্রতিনিধি
কী ঘটেছিল ময়মনসিংহের ইশ্বরগঞ্জে?

মফিজুল ইসলাম মফিজ, ময়মনসিংহ: 
গত ২৬ এপ্রিল বুধবার ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলায় পূর্বঘোষিত একটি বিক্ষোভ সামাবেশ করে ইত্তেফাকুল উলামা পরিষদ নামক একটি সংগঠন। সমাবেশে অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে অনৈসলামিক কাজ করার অভিযোগ করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে দেখা যায় ইত্তেফাকুল উলামার নেতৃবৃন্দকে। এসময় তারা হেযবুত তওহীদকে ইসলামবিদ্বেষী, আলেমবিদ্বেষী ইত্যাদি অভিযোগ করে উস্কানিমূলক বিভিন্ন কথা বলেন। সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়ি অভিমুখে রওনা হয় ইত্তেফাকুল উলামার নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে  সেই মিছিল থেকে হেয়বুত তওহীদের সদস্যদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালায় উত্তেজিত জনতা। এসময় পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে হেযবুত তওহীদের সদস্যরাও। পরে উভয়পক্ষের সংঘর্ষে ২০ জনের মতো আহত হয়। এসময় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোদাব্বিরুল ইসলামের বাড়িসহ মোট পাঁচটি বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় ইত্তেফাকুল উলামা পরিষদের মুসল্লিরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বেশ কিছুদিন যাবৎ এলাকায় এই দুই সংগঠনের মধ্যে নীরব উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ঘটনার সূত্রপাত মূলত ঈদের কয়েকদিন আগে ইত্তেফাকুল উলামা কর্তৃক হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে প্রচার করার মধ্য দিয়ে। যেখানে হেযবুত তওহীদ ইসলাম বিদ্বেষী আন্দোলন বলে প্রচার করা হয়। এ ঘটনার পর এলাকায় এ বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে একটি সমাবেশের আয়োজন করে ইত্তেফাকুল উলামা। সমাবেশ শেষে মিছিল বের করে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়িতে হামলা চালালে হেযবুত তওহীদও পাল্টা হামলা চালায়। তবে স্থানীয়দের কেউ কেউ এ ঘটনাকে সাবেক চেয়ারম্যান মোদাব্বিরুল ইসলাম ও বর্তমান চেয়ারম্যান সেলিম খানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিণাম বলেও ধারণা করছেন। 
হেযবুত তওহীদের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা সভাপতি নাজমূল ইসলাম জানান, ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে লক্ষ করা যায়, একটি চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী গোষ্ঠী মিথ্যা হ্যান্ডবিল রচনা করে এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অশান্তিময় করে তোলার একটি হীনপ্রচেষ্টা শুরু করে। এলাকার সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অশান্ত করে তোলার জন্য তারা ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে একটি মিথ্যা হ্যান্ডবিল উচাখোলা বাজারে কিছু শিশু কিশোরদের হাতে দিয়ে এলাকায় ছড়িয়ে দেয় ইত্তেফাকুল ওলামা পরিষদ। হ্যান্ডবিলটিতে হেযবুত তওহীদের নামে কিছু ধর্মীয় স্পর্শকাতর কথা চালিয়ে দেওয়া হয় যা আদৌ হেযবুত তওহীদের বক্তব্য নয়। বিষয়টি গুরুতর বিবেচনায় হেযবুত তওহীদের সদস্যরা দ্রুত ঈশ্বরগঞ্জ থানাকে অবগত করে এবং উক্ত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে একটি সাধারণ ডায়েরি করে। 
তিনি আরো জানান, গত ২৫ এপ্রিল মঙ্গলবার সাড়ে এগারোটার দিকে ‘উচাখিলা পরিবার’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপে একটি ব্যানার পোস্ট করা হয় যাতে পরদিন ২৬ এপ্রিল বুধবার হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ মিছিলে যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়। ব্যানারটিতে আয়োজনকারী হিসাবে ‘ইত্তেফাকুল ওলামা, উচাখিলা’ এর নাম উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি নজরে আসলে সাথেসাথেই থানাকে বিষয়টি অবগত করা হয়। কিন্তু থানা প্রশাসন এখানে অদূরদর্শীতার পরিচয় দেয়। তারা বিষয়টিকে খুবই হালকা ভাবে নেয় এবং সমাবেশ বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নেয় না। তাদের ধারণা ছিল আয়োজনকারীরা শান্তিপূর্ণ মিছিল করবে, কোনো সমস্যা হবে না। উগ্রবাদীদের নীল নকশা ধরতে ব্যর্থ হয় তারা। 
নাজমূল ইসলাম বলেন, প্রকৃতপক্ষে এই সমাবেশটি ছিল হামলা করার প্রস্তুতিমূলক সমাবেশ। সমাবেশে তারা হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়। লোকদেরকে আক্রমণের জন্য চরমভাবে উত্তেজিত করতে করে। এক পর্যায়ে মো. আলী আক্তার মুন্সী (৪৫), আব্দুস সাত্তার পীর (৬৫) ও মো. মকবুল হোসেনের নেতৃত্বে হামলার উদ্দেশ্যে মিছিল নিয়ে হেযবুত তওহীদের সদস্য হেলালুদ্দিনের বাড়ির দিকে যেতে থাকে। মিছিলে ‘হেযবুত তওহীদের আস্তানা গুড়িয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ শ্লোগান দিতে থাকে। মিছিলে প্রায় দুই থেকে আড়াইশ’ উগ্রবাদী যোগ দেয়। মিছিল বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলে বিনা উস্কানিতে হামলা শুরু করে উগ্রবাদীরা। তারা রাম দা, কিরিচ, রড, লাঠি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাড়িতে অবস্থানরত হেযবুত তওহীদের নির্দোষ নিরপরাধ নিরস্ত্র সদস্যদের উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 
প্রাণ বাঁচাতে হেযবুত তওহীদের সদস্যরা নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেও অন্তত দশজন আহত হন। এর মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। তাদের প্রত্যেকের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। উগ্রবাদী গোষ্ঠী দফায় দফায় হামলা চালাতে থাকে। এসময় তারা হেযবুত তওহীদের ঈশ্বরগঞ্জ থানা সভাপতি নাজমুল ইসলামের ভাই রাজিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান একেএম মোদাব্বিরুল ইসলামের বাড়িও ভাংচুর করে। এসময় তারা বাড়িতে থাকা কয়েকটি মোটর সাইকেল ও আসবাবপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে তাদেরকে নিবৃত করে। 
ইত্তেফাকুল উলামার নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে পাওয়া না গেলেও ফেসবুকে তাদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, হেযবুত তাওহীদ ইসলাম বিদ্বেষী একটি দল। তারা আলেমদের বিরুদ্ধে কথা বলে। হেযবুত তাওহীদ ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করায় সাধারণ মানুষকে সুপথে ফেরাতে কর্মসূচি দেয় ইত্তেফাকুল উলামা পরিষদ। তাদের লক্ষ্য হেযবুত তওহীদের কার্যক্রম বন্ধ করা। ঘটনার দিন সে লক্ষ্যেই তারা সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশ শেষে হেযবুত তওহীদ বিরোধী মিছিল বের করলে মিছিলে অতর্কিত হামলা চালায় হেযবুত তওহীদের সদস্যরা। এতে ইত্তেফাকুল উলামা পরিষদের ১৫ জন নেতাকর্মী আহত হয়। এর প্রতিবাদে আজ শুক্রবার পুনরায় বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে ইত্তেফাকুল উলামার উচাখিলা শাখা।    
হামলার শিকার হেযবুত তওহীদের সদস্য ব্যবসায়ী শাহজাহান জানান, তাঁর দোকানে ক্যাশবাক্সে থাকা নগদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও সাড়ে তিন লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। তারা আবারো হামলা করবে বলে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। 
স্থানীয়রা জানায়, পরিস্থিতি এখন কিছুটা নীরব থাকলেও পুনরায় সংঘর্ষ বাধতে পারে। এই মুহূর্তে কোনো পক্ষকেই মিছিল কিংবা সমাবেশ করতে দেওয়া ঠিক হবে না। 
ইত্তেফাকুল উলামার উচাখিলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আখতারুজ্জামান বলেন, হেযবুত তাওহীদ এলাকায় ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাই সাধারণ মানুষকে সুপথে ফেরাতে কর্মসূচি দেওয়া হয়। সভা শেষে মিছিল শুরু করলে তারা হামলা চালায়। এতে আমাদের ১৫ জনের বেশি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।   
এদিকে, ঘটনার পর হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে দেখা যায় রাজিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানকে। দায়িত্বশীল পর্যায়ের কোনো লোকের মুখে এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য যে ভয়াবহ ধরনের দাঙ্গার কারণ হতে তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে কি ১৫ দিন আগে থেকে ছড়ানো একটি সাম্প্রদায়িক আগুনে হাওয়া দিয়ে আসছিল বর্তমান চেয়ারম্যান? এই হামলার ঘটনা কি সাবেক চেয়ারম্যান মোজাব্বিরুল ইসলামের সাথে বর্তমান চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিণাম? এমন সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। 
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোজাব্বিরুল ইসলাম বলেন, আমার বাসার সকল ভাড়াটিয়াদের ঘরে থাকা মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। প্রায় ২ লাখ টাকা মূল্যের বাইকটি ভেঙ্গে চুরমার করেছে। হামলাকারীদের তাণ্ডব এর দৃশ্য,  কাণ্ডকারখানা সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে রয়েছে। তিনি এ ঘটনায় জড়িত সাবেক মেম্বার হারুন অর রশিদ, যুবলীগ নেতা মাহবুব হামলাকারীদের নাম উল্লেখ করে এদেরকে গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাজারে পুলিশের টহল জোরদার করার দাবি জানান।
ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি মোস্তাছিনুর রহমান রহমান বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। উভয়পক্ষ ইট পাটকেল ছোঁড়াছুড়ি করছিল। আমরা তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে এসেছি। তিনি আরো বলেন, এর আগে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা ঘটার আগেই হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে দাখিল করা জিডির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে এরকম সহিংসতা এড়ানো যেত কিনা এমন প্রশ্নের জবাব ওসি সাহেব এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি। 
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) বেলা ১২টায় ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করে হেযবুত তওহীদ। এসময় হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে ৫টি দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলো- দ্রুত হামলাকারীদের সবাইকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। মিথ্যা হ্যান্ডবিলের রচয়িতাকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। লুটপাট করা অর্থ দ্রুত উদ্ধার ও অবিলম্বে ভাংচুর করে ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের ক্ষতিপুরণ দিতে হবে। উচাখিলার নির্দোষ নিরপরাধ আইন মান্যকারী হেযবুত তওহীদ সদস্যদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।  সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে যারা হামলার উস্কানি ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে আইসিটি অ্যাক্টের আওতায় আনা হবে।