Date: May 07, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / জাতীয় / নিজ অসিয়ত অনুযায়ী শায়িত হলেন না শিক্ষানুরাগী সৈয়দ আবুল হোসেন! - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

নিজ অসিয়ত অনুযায়ী শায়িত হলেন না শিক্ষানুরাগী সৈয়দ আবুল হোসেন!

October 28, 2023 02:20:48 PM   জেলা প্রতিনিধি
নিজ অসিয়ত অনুযায়ী শায়িত হলেন না শিক্ষানুরাগী সৈয়দ আবুল হোসেন!

মাদারীপুর প্রতিনিধি:
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, সমাজ সেবক, সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেনকে তার অসিয়ত অনুযায়ী নিজ জন্মভূমি মাদারীপুর জেলার ডাসারে দাফন করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। জনসমক্ষে অসিয়ত করে যাওয়ার পরও রহস্যজনক কারণে তাকে চিরস্থায়ীভাবে শায়িত করা হয়েছে শ্বশুরবাড়ি  সিরাজগঞ্জের মাটিতে। এরআগে গত ২৫ অক্টোবর (বুধবার) ভোরে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

জানা যায়, সৈয়দ আবুল হোসেনের মৃত্যুর পর তাকে দাফনের জন্য মাদারীপুরের ডাসারে তার পরিবার ও আত্মীয়রা সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। জানাজায় অংশ নিতে ও একনজর দেখতে তার জানাজা ও দাফনের জন্য পূর্বনির্ধারিত গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসারে শুক্রবার সকাল থেকেই হাজার হাজার দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও এলাকাবাসী ভিড় জমায়। শুক্রবার লাশ শ্বশুরবাড়ি সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে নেওয়ার পর  ডাসারে লাশ আনার কথা থাকলেও এনায়েতপুরে তার জানাজা শেষে দাফন করার সিদ্ধান্ত দেন তার স্ত্রী খাজা নার্গিস, দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেন। জন্মস্থান, শৈশব, কৈশোর, রাজনীতি ও মাটি মানুষের সাথে মিশে থাকা ডাসারের কৃতি সন্তান খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও মানবিক হৃদয়ের অধিকারী বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত সাবেক এ মন্ত্রীর দাফন নিজ এলাকায় না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তার পরিবারের সদস্য, এলাকাবাসী ও নেতাকর্মীরা। নিজ এলাকার হাজার হাজার মানুষের একনজর দেখার সুযোগ না দিয়ে চিরস্থায়ীভাবে শায়িত করাটি রহস্যজনক বলেও মনে করছেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ও শোক বেড়ে গেছে এই দুই উপজেলাসহ মাদারীপুর জেলার মানুষের।

তবে সৈয়দ আবুল হোসেনের মৃত্যুর পর তার দাফন মাদারীপুরের ডাসারায় নিজ নির্মিত কবরস্থানে হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন তার ভাতিজা নুরুজ্জামান বাবু। তার চাচা সৈয়দ আবুল হোসেনের নির্মিত মসজিদের পাশেই চাচা ও চার স্ত্রী খাজা নার্গিসের কবর তৈরি করা ছিল বলেও সে সময় সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন তিনি।

এদিকে হাজার হাজার মাদারীপুরবাসীর চোখের জল, আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় দুঃখে, ক্ষোভে, যন্ত্রণায়  বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে এই এলাকার সাধারণ মানুষ ও পরিবারের সদস্যরা। সহস্র মানুষের হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে লক্ষ মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালবাসাকে পদদলিত করে আবুল হোসেনের মরদেহবাহী হেলিকপ্টারটি ডাসারে না এসে সিরাজগঞ্জে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে। সিরাজগঞ্জে দাফনের খবর শুনে মাদারীপুরবাসীর প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যুশোকে শোকাহত হাজার হাজার মানুষের শোক আরও বেড়ে যায়। মাদারীপুরের আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা কোনোভাবেই বিষয়টা মেনে নিতে পারছে না। দুঃখে, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় তারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে। চোখের জল মুছতে মুছতে অনেকে ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরে যান। তাদের প্রশ্ন, কি এমন ঘটেছিল যার জন্য আবুল হোসেনকে তার পিতৃভূমি, যে মাটির মানুষের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছে, তার সংসদীয় আসনে যেখান থেকে তিনি পাঁচ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, সেই মাটিতে তাকে চির নিদ্রায় যেতে দেওয়া হলো না?

জানা যায়, এই নেতার জানাজায় অংশ নিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ ও আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সহ কেন্দ্রীয় নেতারা এসে পরে ঢাকা ফিরে যান। সৈয়দ আবুল হোসেন মৃত্যুর আগে বাড়ির পাশেই মার্বেল পাথর দিয়ে সুরম্য কবরস্থান বানিয়ে গিয়েছিলেন। সেটি দেখেই শেষ পর্যন্ত ফিরতে হয় আগতদের।

পরিবার, নিকটাত্মীয় ও নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সৈয়দ আবুল হোসেন অসিয়ত করে গিয়েছিলেন তার জন্মভূমি ডাসারে তাকে কবর দেওয়ার জন্য। নিজের জন্য একটি কবর নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে তার মা-বাবা চিরদিনের জন্য শায়িত হয়ে আছেন। কিন্তু তার স্ত্রী ও দুই কন্যা তার শ্বশুরবাড়ির এলাকা সিরাজগঞ্জ জেলায় কবরস্থ করান। তবে তার স্ত্রী-কন্যার উদ্দেশ্য  তিনি আগেই টের পেয়ে নিজ প্রতিষ্ঠিত  ডি.কে. আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজ এর মিটিংয়ে তিনি তার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে জানান। যা ওই কলেজের মিটিংয়ের রেজ্যুলেশনে সংরক্ষিত এবং জেলা প্রশাসক কর্তৃক স্বাক্ষরিত রয়েছে।

এদিকে সেই ডি.কে. আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজের ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট তারিখের মিটিং রেজ্যুলেশনের একটি কপি এসেছে দৈনিক দেশেরপত্রের কাছে। এতে দেখা যায় কলেজের সেই মিটিং এর রেজুলেশনকৃত অসিয়ত নামায় স্বাক্ষর রয়েছে সেই মিটিংয়ে উপস্থিত শিক্ষক ও তৎকালীন জেলা প্রশাসকের।

সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট ভাই ডা. সৈয়দ হাসান অভিযোগ করে বলেন, সৈয়দ আবুল হোসেন মারা যাওয়ার আগে নিজে অসিয়ত করে গেছেন ডাসারায় তার দাফন করার জন্য, যার সাক্ষী মাদারীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলামসহ তার প্রতিষ্ঠিত   ডি.কে. আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমি এন্ড কলেজের শিক্ষকবৃন্দ। কিন্তু তার স্ত্রী খাজা নার্গিস, দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেনের সিদ্ধান্তে তাকে সিরাজগঞ্জে দাফন করা হয়। আমি তার স্ত্রী ও সন্তানদের একথা বলেছিলাম তবুও তারা আমার কথা শুনেনি। আমার আর কিছুই বলার নেই আল্লার কাছে তার রুহের জন্য দোয়া চাওয়া ছাড়া।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, সৈয়দ আবুল হোসেনের সৈয়দপুরের এনায়েতপুরে তার শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়া আর কেউ চেনেন না। কিন্তু এই মাদারীপুরের কালকিনি ও ডাসারার হাজার মানুষ তাকে ভালোবাসেন। এখানকার সাধারণ মানুষের আত্মায় গেথে আছেন তিনি। তাদের আবেগ-অনুভূতির কথা চিন্তা করে স্ত্রী খাজা নার্গিস, সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেনের লাশ ডাসারায় দাফনের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন।

অভিযোগের বিষয়ে তার মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন বলেন, সরকারের উদ্র্ধতন থেকে  তার বাবার লাশবাহী হেলিকপ্টারটি ডাসারায় না নিতে দেওয়ায় তারা সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে তাকে দাফন করা হয়েছে। তবে তার পূর্ব ইচ্ছানুযায়ী সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে দাফন করা হবে বলে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তার স্ত্রী খাজা নার্গিস।

উকিপিডিয়া অনুযায়ী, সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৫১ সালের ১ অক্টোবর মাদারীপুরের ডাসার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম সৈয়দ আতাহার আলী এবং মাতা মরহুম সৈয়দা সুফিয়া আলী। তিনি ১৯৭২ সালে স্নাতক এবং ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আবুল হোসেন ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে খাজা নার্গিস হোসেনকে বিয়ে করেন। তার দুই কন্যা সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর আবুল হোসেন সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন এবং পরবর্তীকালে ব্যবসায় শুরু করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে সাহকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং সাহকো এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এশিয়ার বোয়াও ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন, যা ২০০১ সালে চিনের হাইনান প্রদেশে ধারণ করা হয়েছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৯ সালে পর পর চারটি সাধারণ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ থেকে বাংলাদেশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পূর্ববর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। নিজ এলাকায় তিনি অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। ফলে অনেকেই তাকে বিদ্যাসাগর খেতাবও দিয়েছেন।