Date: May 03, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সাহিত্য / স্বর্ণযুগের মাদ্রাসা বনাম আজকের মাদ্রাসা - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

স্বর্ণযুগের মাদ্রাসা বনাম আজকের মাদ্রাসা

April 19, 2024 06:38:08 PM   রিয়াদুল হাসান
স্বর্ণযুগের মাদ্রাসা বনাম আজকের মাদ্রাসা

বর্তমানে মাদ্রাসা বলতে আমরা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুঝে থাকি। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার নীতি মান্য করে ধর্ম এখন আমাদের জীবনের একটি ব্যক্তিগত পালনীয় বিষয়। রাষ্ট্রের পরিচালনা পদ্ধতিতে ধর্মের কোনো বিধি-বিধান বা নৈতিকতার প্রভাব থাকা কাম্য নয়। আমরা মুসলমানেরা ব্রিটিশদের পদানত হওয়ার আগে রাষ্ট্রীয় জীবন অনেকাংশে ইসলামের নীতি-আদর্শ দ্বারাই পরিচালিত হত। তখন ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না, ধর্মের আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, দর্শন ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত হত। তাই সে সময় মাদ্রাসাগুলোতে কেবল ইসলামের জাতীয়-রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়া হত। শিক্ষার্থীরা ইসলামের আইনশাস্ত্রের (ফিকাহ) জ্ঞান লাভ করে আদালতে সেই জ্ঞানকে প্রয়োগ করতে পারতেন। ঠিক এখন যেভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশদের তৈরি আইন ও দণ্ডবিধি অধ্যয়ন করে উকিল, ব্যরিস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট-জজ তৈরি হয়। পার্থক্য হল, আগে পড়ানো হত ইসলামের আইন, এখন পড়ানো হয় ব্রিটিশের আইন।

আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে এখনও সেই ফিকাহ, শরিয়তের বিধি-বিধানের বই পড়ানো হয়, ছাত্ররা তোতাপাখির মত তা মুখস্থ করে, কিন্তু সেসব বিধান জাতীয় জীবনে অচল। রাষ্ট্র থেকে ধর্ম বিদায় নিয়েছে বহু আগে। তাই মাদ্রাসার ছাত্ররা পাশ করে আদালতে কাজ পান না। তাদেরকে কাজ করতে হয় মসজিদ মাদ্রাসায় অর্থাৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। তাদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে মোড়ে মোড়ে তৈরি হচ্ছে অগণিত মাদ্রাসা। সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ এসব মাদ্রাসার উপর খাটে না। কারণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মানেই মহা-পবিত্র ও স্পর্শকাতর স্থান। সরকার এগুলোকে স্পর্শ করে না। গণতান্ত্রিক দেশে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে তুষ্ট করেই সরকারকে ক্ষমতায় থাকা লাগে। এই সুযোগ নিয়ে মাদ্রাসাগুলোতে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। গণমাধ্যমে আমরা নিয়মিত সেসব খবর পাই এবং এড়িয়ে যাই।

মাত্র দুদিন আগের ঘটনা। ভোলার চরফ্যাশনের একটি মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র মো. ইয়ামিনকে (১৩) ২০ রমজান থেকে ইতেকাফে না বসার কারণে তার হাত-পা ও মুখ বেঁধে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষক হাবিব। (দৈনিক যুগান্তর, ৪ এপ্রিল ২০২৪)। প্রতিবছর বহু ছেলেশিশু মাদ্রাসা শিক্ষকদের বলাৎকারের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। নোয়াখালীর চাটখিলে চার ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে মাদ্রাসাশিক্ষক সাইফুর রহমানকে (২৬) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বলাৎকারের শিকার শিশুদের বয়স ছিল ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। কয়েক মাস ধরে ভয় দেখিয়ে নুরানি শাখার এই শিক্ষক চার শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসার ভেতরে বলাৎকার করে আসছিলেন। (ডেইলি স্টার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪)। এই মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে তাদের শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নিয়ে যান। তাদেরকে দাঙ্গায় ব্যবহার করেন এবং পুলিশের গুলি ও লাঠিচার্জের মুখে ঠেলে দিয়ে নিজেরা পালিয়ে যান।

আগেই বলেছি, আমরা বর্তমানে মাদ্রাসার যে চিত্র দেখতে পাই, আগে কিন্তু তেমনটা ছিল না। মাদ্রাসা শব্দটির অর্থ কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। মাদ্রাসা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘র্দাসুন’ থেকে যার অর্থ ‘পাঠ’। সুতরাং মাদ্রাসা অর্থ পাঠশালা। মহানবী (সা.) এমন এক যামানায় জন্মগ্রহণ করেন, যে যামানায় আরব সমাজ জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। মহানবীর (সা.) প্রদত্ত শিক্ষার মাধ্যমে প্রথমে মানুষের ভিতরের অন্ধকার দূর হয়েছে, পরে সমাজের অন্ধকার দূর হয়ে একটি আলোকিত সভ্যতার সোনালি ইতিহাস রচিত হয়েছে। তাই তিনি তাঁর সাহাবিদেরকে কী শিক্ষা দিতেন, সেটা জানা জরুরি। তিনি কি আরবি মাখরাজ শিক্ষা দিতেন, তিনি কি বালাগাত-মানতিক শিক্ষা দিতেন, তিনি কি ইলমুল ফিকাহ, উসুলে ফিকাহর সূক্ষ্মতত্ত্ব শিক্ষা দিতেন? তিনি কি ওজুর কয় ফরজ, কয় সুন্নত, কয় নফল শিক্ষা দিতেন?
বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোতে তো এগুলোই শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু রসুলাল্লাহ তাঁর সাহাবিদেরকে হেদায়াতের জ্ঞান, তওহীদের জ্ঞান, দীনের আকিদা শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর উপর যে আয়াতগুলো নাজিল হত সেগুলো তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং সংগ্রাম করেছেন বাস্তব জীবনে সেগুলো প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আল্লাহর নাজিলকৃত কেতাবের প্রথম আয়াত ইক্বরা, পাঠ কর অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করো (সুরা আলাক্ব ১)। আল্লাহর কালাম পাঠ করে শোনানোই ছিল তাঁর ইসলাম প্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। মক্কায় থাকতে তিনি সাহাবিদেরকে নিয়ে সাফা পর্বতের পাদদেশে আরকাম বিন আবুল আরকামের (রা.) বাড়িতে সমবেত হতেন। রসুলাল্লাহ তাদেরকে কোর’আন শিক্ষা দিতেন, দীনের আলোচনা করতেন। তাঁর কাছ থেকে কোর’আন শিক্ষা করে আবু বকর (রা.), খাব্বাব ইবনে আরাত (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ মানুষের কাছে সেই শিক্ষা প্রচার করতেন। তাঁরা ছিলেন সেই প্রাথমিক যুগের শিক্ষক।

মওলানা আব্দুস সাত্তার তাঁর ‘তারিখ-ই-মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’ গ্রন্থে রসুলাল্লাহর (সা.) যুগের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর বর্ণনামতে মদিনায় হিজরতের পর প্রধানত মসজিদে নববীতে বসেই তিনি সাহাবিদের সঙ্গে দীনের আলোচনা করতেন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাঁর সামনে একত্রে বসে কথা শুনতেন। সেখানে ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থাও ছিল। এ সময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন বিধান নাজিল হতে থাকে- যেমন ব্যবসা বাণিজ্য, বিয়েশাদি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, অর্থব্যবস্থা, যুদ্ধনীতি ইত্যাদি। এগুলো শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি রসুলাল্লাহ (সা.) সাহাবীদেরকে দাওয়াতি কাজ করার পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। প্রশিক্ষিত সাহাবীদেরকে বিভিন্ন গোত্রে তিনি প্রেরণ করতে কোর’আন শিক্ষা দেওয়ার জন্য। যে সাহাবিরা যুদ্ধবিদ্যায় বেশি পারদর্শী ছিলেন, তারা অন্যদেরকে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দিতেন। কখনও কখনও দৌড়, কুস্তি, ঘোড়দৌড়, শরীরচর্চা, তীরনিক্ষেপ, বর্শাচালনার প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হত। আল্লাহর রসুল স্বয়ং এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, কখনও তিনি উপস্থিত থেকে প্রতিযোগীদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। কিছু সাহাবি ছিলেন চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী। আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁদেরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন অন্যান্য নারীদেরকে সেবিকা বা নার্স হিসাবে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য। তাঁরাই যুদ্ধের মাঠে এবং যুদ্ধ থেকে ফিরে আহত সৈনিকদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। যেসব সাহাবি লিখতে পড়তে পারতেন, তাদেরকে দিয়ে রসুলাল্লাহ ওহি লেখাতেন। তাদের মোট সংখ্যা ছিল ৪৫ জন। তিনি মদিনার শিশু-কিশোর ও নিরক্ষর নাগরিকদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। বদরে বন্দী হওয়া একদল শিক্ষিত ব্যক্তিদের মুক্তিপণ ছিল তারা প্রত্যেকে দশজন করে মদিনার বালক-বালিকাকে লিখতে পড়তে শেখাবেন।

অনেক সাহাবি সার্বক্ষণিকভাবে রসুলাল্লাহর আশপাশে থাকতেন, মসজিদে নববীতেই তারা অবস্থান করতেন। তাঁদেরকে বলা হত আসহাবে সুফ্ফা। রসুলাল্লাহর মুখনিসৃত প্রতিটি কথা তারা শ্রবণ করতে পিপাসু ছিলেন এবং তাঁরা সেগুলো পালন করতে সবার চেয়ে অগ্রণী ছিলেন। পরবর্তীকালে এই সাহাবিদের মধ্যে যাঁরা জীবিত ছিলেন তাঁরা দীনের জ্ঞান মানুষকে দান করেছেন। তাঁরাও মসজিদে বসেই মানুষকে দীনের আকিদা, মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা দিয়েছেন, কেউ কেউ নিজের বাড়িতে বসেই আলোচনা করতেন। নবুয়তের প্রথম দিন থেকে উমাইয়া বংশের শাসনামলের প্রথম ভাগ পর্যন্ত প্রায় একশ বছর সময়কালে মাদ্রাসা বলে আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি (জীবন পথের পাথেয়: আবুল হাসান নাদভী)। এখনকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত শ্রেণি মোতাবেক সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদির তো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ তখন কোনো হাদিস বা ফিকাহর কিতাবই রচিত হয়নি। আর কয়েক কপি কোর’আন ছিল কেবল শাসকদের দরবারে সংরক্ষিত।

রসুলাল্লাহর (সা.) কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল, কেউ যেন দীনের জ্ঞান অন্যকে শিক্ষা দিয়ে কোনো হাদিয়া বা উজরত (বিনিময়) গ্রহণ না করে। কেউ নিলে তার ঠাঁই হবে জাহান্নামে সেটাও তিনি সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি কোর’আন শিক্ষাদানের উপর একটি ধনুকও গ্রহণ করবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার পরিবর্তে জাহান্নামের আগুনের ধনুক তার গলায় লটকাবেন।” (ইবনে মাজাহ)। আর পবিত্র কোর’আনে আল্লাহও বারবার বলেছেন, তোমরা আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করো না (সুরা বাকারা ৪১)। ইসলামের জ্ঞান কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় বিনামূল্যে দিতে হবে- এটি আল্লাহর দীনের একটি চিরন্তন নীতি।

ইসলামের সোনালি যুগের মাদ্রাসা
প্রায় ১,০০০ বছর ধরে তদানীন্তন অর্ধ-পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত মুসলিম বিশ্বে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা জুড়ে অন্তত ৬০টি প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এগুলোর মধ্যে প্রাচ্যে বাগদাদ এবং পশ্চিমে কর্ডোভা ছিল সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। এই শহরগুলোতে যে শিক্ষাকেন্দ্রগুলো ছিল সেগুলোকে মাদ্রাসাই বলা হত। আব্বাসী খলিফা আল মুনতানসির বিল্লাহ (শাসনকাল ১২২৬-১২৪২) বাগদাদে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ‘আল-মাদ্রাসা আল-মুনতানসিরিয়া’। এই মাদ্রাসাটির কারুকার্যময় ভবন ও চত্ত্বর এত যুদ্ধ হামলার মাঝেও ইসলামের স্বর্ণযুগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 
অষ্টম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের শাসকশ্রেণি, আমির-উমরাহ, উজির-নাজির, প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য সুপরিচিত পণ্ডিতদের গৃহশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করতেন। এই গৃহশিক্ষকগণ ছাত্রদের মূলত আরবি, সাহিত্য, ধর্ম, গণিত এবং দর্শন শেখাতেন। আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল মসজিদকেন্দ্রিক মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসাগুলোতে প্রধানত ফিকাহ বা ইসলামের আইনশাস্ত্র (Islamic jurisprudence) অধ্যয়ন করা হতো। পাশাপাশি ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসা ও গণিতের মতো বিষয়গুলো নিয়েও সেখানে শিক্ষাদান ও গবেষণা করা হতো। মাদ্রাসা কমপ্লেক্সগুলো সাধারণত একটি মসজিদ, বোর্ডিং এবং একটি গ্রন্থাগার নিয়ে গঠিত হত। রাষ্ট্র অথবা অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব মাদ্রাসার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, অধ্যাপকদের বেতন, ছাত্রদের উপবৃত্তি ইত্যাদি ব্যয় বহন করা হতো। তবে এই মাদ্রাসাগুলোতে আধুনিক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত মানসম্মত পাঠ্যক্রম বা সনদ প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব ছিল।

তবে মরোক্কোতে ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাতিমা আল ফিহরি নামে একজন বিদুষী নারী নিজের অর্থে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে জামিয়াত-আল-কারাউইন (University of al-Qarawiyyin) নামে পরিচিত। জামিয়া শব্দের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়। এই মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থীদেরকে চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ডিগ্রি বা সনদ প্রদান করা হতো। এই সনদকে বলা হত ‘ইজাযাহ’। হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি পার্চমেন্টে এই প্রশংসাপত্র লিখা হত। শহরের একজন বড় চিকিৎসক এবং প্রধান বিচারপতির (কাজিউল কোজ্জাত) হাত দিয়ে এই সনদ শিক্ষার্থীদেরকে প্রদান করা হতো। বিশ্বের প্রাচীনতম ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে ও ইউনেস্কোর রেকর্ডে এর নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে।

অষ্টম শতাব্দিতে নির্মিত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সাড়া জাগানো ও প্রভাবশালী জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র বায়তুল হিকমা (House of wisdom)। অনুবাদকেন্দ্র হিসেবে এর যাত্রা শুরু হলেও ক্রমেই তা গবেষণাকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মানমন্দিরে পরিণত হয়েছিল। আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশিদ (শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর রাজধানী বাগদাদে এটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর পুত্র খলিফা আল-মামুন ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে সেটির পূর্ণতা দান করেন। সিরিয়ান খ্রিষ্টান হুনায়ন ইবনে ইসহাককে বায়তুল হিকমার মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতির পণ্ডিতদের সম্মেলন ঘটেছিল এই প্রতিষ্ঠানে। এ প্রতিষ্ঠানটি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আলকেমি, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানচর্চার অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থান হয়ে উঠে। ভারতীয়, গ্রীক ও পারসিয়ান রচনা ব্যবহার করে পণ্ডিতরা বৈশ্বিক জ্ঞানের বিরাট ভাণ্ডার অর্জন করেন এবং এর মাধ্যমে তাদের নিজেদের আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে যান। নবম শতকের মধ্যভাগে বাইতুল হিকমাহ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গ্রন্থভাণ্ডার। মোঙ্গলদের বাগদাদ অবরোধের সময় শহরের পতন হলে দীর্ঘ ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে জ্ঞানবিজ্ঞানের সোনালি ধারা বজায়ের আলোকবর্তিকা বায়তুল হিকমাহও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কথিত রয়েছে, হত্যাকাণ্ড চলার সময় যদিও পারস্য মনীষী নাসিরুদ্দিন তুসি ৪০ হাজার গ্রন্থ অনত্র সরিয়ে নেন, তবু এত বিপুল পরিমাণ বই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় যে বইয়ের কালিতে আব্বাসীয় প্রাসাদসংলগ্ন টাইগ্রিস নদীর পানি কালো হয়ে যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দি থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ ধরা হয়। এ সময় মুসলিম বিজ্ঞানীরা বিশ্বসভ্যতাকে উপহার দিয়েছে অগণিত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। ভূগোলবিদ, দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ আল খাওয়ারিজমি (Algorism), পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, ভূগোলবিদ, হাফিজ, যুক্তিবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনোবিজ্ঞানী ইবনে সিনা (Avicenna), সংগীতজ্ঞ, , চিকিৎসক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, কবি ও দার্শনিক ইবনে বাজ্জাহ (আবসঢ়ধপব), জ্যোতির্বিদ আল ফারগানি (Alfraganus), পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র অংকনকারী আল ইদ্রিসি (Dreses), কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের বিশারদ আল কিন্দি (Alkindus), জ্যোতির্বিদ আল বাত্তানি, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী আল রাজিসহ অগণিত বিশ্ববরেণ্য শিক্ষক মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন মাদ্রাসায় গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন। তাঁদের লেখা অমূল্য গ্রন্থাবলি সব মাদ্রাসাগুলোতে কপি করে পড়ানো হতো। যেমন ইবনে সিনা তাঁর সমগ্র জীবনে ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাসহ মোট ২৪০টি গ্রন্থ বর্তমানে টিকে রয়েছে। তাঁর লেখা কানুন ফিত তীব (The Canon of Medicine) বহু শতাব্দী ধরে ইউরেশিয়া জুড়ে মেডিক্যাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

অগণিত মুসলিম শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, কবি-সাহিত্যিকদের মাধ্যমে মুসলিম সভ্যতা তখন জ্ঞানের আকাশে সূর্যের মত প্রভা বিস্তার করছিল। তাঁদের নীরব অনুপ্রেরণাই পশ্চিমা দেশগুলোকে শিক্ষা ও জ্ঞানের জগতে রেনেসাঁ সৃষ্টিতে সক্ষম করেছিল। সেই জ্ঞানকেন্দ্রগুলোর নামও ছিল মাদ্রাসা, আজকেও আমাদের পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অগণিত মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসার সাথে আজকের মাদ্রাসার আসমান জমিন তফাৎ। আজকের মাদ্রাসাগুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণা নেই। কারণ তাদের কাছে মাসলা-মাসায়েলের জ্ঞানই হচ্ছে আসল জ্ঞান (ইলম), এর বাইরে কোনো প্রকার জ্ঞানচর্চাকে তারা দুনিয়াবি জ্ঞান বলে তাচ্ছিল্য করেন। তাই মক্তব থেকে শুরু করে দাওরা পাশ করা পর্যন্ত তারা কেবল ওজুর মাস’আলা, হায়েজ নেফাসের মাস’আলা, রোজা ভঙ্গের মাস’আলাই শিখতে থাকেন। ফতোয়া জ্ঞানের বাইরে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তাই এসব মাদ্রাসা থেকে পাস করে কেউ জ্যোতির্বিদ, ভূগোলবিদ, রসায়নবিদ, পদার্থবিদ হয় না। তাদের ধর্মীয় জ্ঞানকে পুঁজি করে উপার্জন করা অর্থাৎ ধর্মব্যবসা ছাড়া আর কোনো উপায়ে জীবিকা হাসিলের যোগ্যতা তৈরি হয় না। প্রতিবছর হাজার হাজার নতুন ‘আলেম’ এসব মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে বেকারত্বের হতাশায় ভুগছেন অথবা ধনীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন নতুন আরেকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার জন্য। মাদ্রাসার শিক্ষক হয়ে তারা কী কী করেন সে বিষয়ে সকলেই কমবেশি অবগত আছেন, যার কিছুটা শুরুতে বলে এসেছি।

মুসলিম সভ্যতার সোনালী যুগে যে মাদ্রাসাগুলো সমগ্র বিশ্বে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে, সেই মাদ্রাসা আজ আর নেই। মুসলিম জাতির গবেষণালব্ধ জ্ঞান বহিঃশত্রুর আক্রমণে অধিকাংশই লুপ্ত হয়ে গেছে, আর কিছু অংশ পাশ্চাত্যে হস্তান্তরিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব সেইসব গবেষণাকে আরো অগ্রসর করে গড়ে তুলেছে বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর বিরাট এক বস্তুবাদী সভ্যতার ইমারত। মুসলিম বিশ্ব তাদের সামনে পদানত, হীনম্মন্যতায় আপ্লুত, লাঞ্ছিত, পরাজিত, রক্তাক্ত। লক্ষ লক্ষ মসজিদ আছে, মাদ্রাসা আছে। কিন্তু গৌরব করার মত কিছুই অবশিষ্ট নেই। গৌরব যা আছে সবই অতীত, আর সেই অতীত সম্পর্কেও রয়েছে এই জাতির সীমাহীন অজ্ঞতা। যদি এ জাতিকে আবার জাগতে হয়, তাহলে নিজেদের ইতিহাসের সঠিক পর্যালোচনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিকল্প নেই।