Date: April 29, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সংগঠন সংবাদ / জানাজায় নারীর অংশগ্রহণ বঙ্গবীরের ভাষ্য বনাম ইসলাম - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

জানাজায় নারীর অংশগ্রহণ বঙ্গবীরের ভাষ্য বনাম ইসলাম

May 02, 2023 11:56:56 AM   নিজস্ব প্রতিবেদক
জানাজায় নারীর অংশগ্রহণ বঙ্গবীরের ভাষ্য বনাম ইসলাম

মুস্তাফিজ শিহাব:
নারীরা পুরুষদের জানাজায় অংশ নিতে পারেন কিনা তা নিয়ে ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ সরব হয়ে উঠেছে। নারীদেরকে সকল সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রযন্ত্র স্বীকার করলেও আমাদের প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কৃতিতে এ বিষয়টি একেবারেই অপন্দনীয়। আমাদের মুফতি মওলানা শ্রেণিটি একান্ত বাধ্য হয়েই একজন নারী রাষ্ট্রনায়ককে মেনে চলছেন। সম্প্রতি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর পর দেখা গেল নারীরা পুরুষদের সাথে সামনের কাতারে জানাজায় অংশ গ্রহণ করেছেন। এর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে পরদিন থেকেই অনলাইনে কন্টেন্ট প্রচার শুরু হয়েছে। দেশের অধিকাংশ ওলামারা একমত যে নারীদের জন্য জানাজার নামাজে অংশ নেওয়া জায়েজ নেই। এমনকি লাশের সঙ্গে যাওয়াও জায়েজ নেই। যদিও প্রায়শই দেখা যায়, আমাদের দেশের মুসলিম নারীরা জানাজার নামাজে অংশ না নিলেও লাশের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে গোরস্থান পর্যন্ত যান।
নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন ২০১৮ সনের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ট্রিবিউনে ‘জানাজার নামাজে মেয়েরা কেন যায় না’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন। সেখানে তিনি জানাজাসহ সব নামাজে মেয়েদের অংশ গ্রহণ নয় শুধু বরং ইমামতি করার অধিকার দিতে দাবি জানিয়েছেন। 
এই বিতর্কটি উস্কে দিয়ে আবার আলোচনায় এসেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ খানকে সখীপুরের নারী ইউএনও ফারজানা আলম গার্ড অব অনার দিতে যান বলে মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয়েছেন বঙ্গবীর। ওই নারী ইউএনওকে একদিনের মধ্যে শাস্তিমূলক বদলি করার দাবিও করেন তিনি। জানাজায় গিয়ে নারী ইউএনওকে দেখেই বলতে থাকেন, ‘...মেয়ে মানুষ যত বড়ই হোক, পুরুষের সঙ্গে জানাজায় শামিল হওয়ার তাঁর কোনো সুযোগ নাই। তিনি এখানে এসে মুক্তিযোদ্ধার লাশের সঙ্গে বেয়াদবি করেছেন। যদি এখন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, তাহলে এখানকার অনেক কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠাতাম।’
এ বিষয়ে ইউএনও ফারজানা আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি জানাজা পড়তে যাইনি। গিয়েছিলাম বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের জন্য। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী হাজার লোকের সামনে আমাকে অপমান করেছেন। তিনি (কাদের সিদ্দিকী) নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’
এর পর থেকে বঙ্গবীর নারীবিদ্বেষী মুফতি ও তাদের অনুসারীদের শুভেচ্ছায় ভাসছেন, একই সাথে শিকার হচ্ছেন ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণির কটাক্ষ ও বিদ্রƒপের। যাহোক, তিনি আলোচনায় এসেছেন এটাই বড় কথা। 
এবার আসুন দেখা যাক, নারীদের জন্য কারো জানাজায় অংশগ্রহণের বিষয়ে ইতিহাস কী বলে। রসুলাল্লাহর ঘনিষ্ঠ সাহাবি সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) যখন এন্তেকাল করেন তখন রসুলাল্লাহর স্ত্রীগণ তাঁর জানাজায় অংশ গ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁর মৃতদেহ মসজিদে নিয়ে আসার জন্য বলেন। তাঁর জানাজার সালাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু সাহাবি অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের কথা মোতাবেক সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের (রা.) দেহ মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে নিয়ে আসা হয়। তখন রসুলাল্লাহর স্ত্রীগণও তাতে অংশগ্রহণ করেন। এ হাদিসটি সহিহ মুসলিম শরীফের জানাযা অধ্যায়ের মসজিদে জানাযা পড়া অনুচ্ছেদের (৩য় খণ্ড) ৬৩ পৃষ্ঠায় রয়েছে। আবূ সালামা ইবনু আবদুর রহমান (রহ.) থেকে বর্ণিত যে, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর ইন্তেকালের পর আয়িশা (রা.) বললেন, তাঁকে মসজিদে নিয়া যাও। যেন আমিও তাঁর জানাযার সালাত আদায় করতে পারি। তাঁর এ কথাটি অপছন্দ করা হল। তিনি বললেন, আল্লার কসম! নিশ্চয়ই নবী (সা.) বায়যার দু’পুত্র সুহায়ল ও তার ভাইয়ের জানাযা মসজিদেই আদায় করেছিলেন। 
এ ঘটনাটি থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নারীদেরকে জানাজায় অংশ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সিদ্ধান্তটি ইসলামের নয়, এই ধ্যান ধারণার জন্ম হয় বহু পরে যখন পর্দা প্রথার নামে নারীদেরকে পেছনে ফেলে রাখার নানা মাসলা-মাসায়েল আবিষ্কার করা হয় তখন। পুরুষ শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায়, সমাজের নিয়ন্ত্রক হওয়ায় তারা চিরকাল চেয়েছে নারীদেরকে পদানত আর আজ্ঞাবহ করে রাখতে। তাদেরকে মানুষের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করাই ছিল সমাজবিধি। তাদেরকে এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সংগ্রাম করে গেছেন সকল নবী-রসুল অবতারগণ। আরবের জাহেলিয়াতের যুগে যে নারীদের কোনো মানবিক মর্যাদা ছিল না, যারা ছিল ভোগের উপকরণ, কন্যা সন্তান হলে পিতার মুখ অন্ধকার হয়ে যেত, তাদেরকে জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা পর্যন্ত করত সেই নারীদেরকে আখেরি নবী (সা.) পুরুষের পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে অবাধ অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তারা মসজিদে গেছেন, সালাতে, ঈদে, জুমায়, আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছেন, তারা হাসপাতালের পরিচালক হয়েছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন, রসুলের (সা.)  সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছেন। যুদ্ধে নারীরা রসদ সরবরাহের দায়িত্ব থেকে শুরু করে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে দুর্দান্ত ও বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকা রেখেছেন। মুসলিম জাতির বহু নারী ছিলেন দুর্ধষ যোদ্ধা যারা রোমান-পারস্যের প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদেরকে বারবার ধরাশায়ী করেছেন। জেনারেল এ আই আকরামের দ্য সোর্ড অব আল্লাহ গ্রন্থে তিনি উম্মতে মোহাম্মদীর নারীদের বীরত্বগাঁথার বহু বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন তিনি দেরার বিন আজওয়ারের (রা.) বোন খাওলা বিনতে আজওয়ারের (রা.) বীরত্বের কথা বলেছেন। রোমান সম্রাটের কাছে খবর গেল যে, মুসলিম যোদ্ধাদের মধ্যে কিছু কমান্ডার আছেন যারা শরীরে বর্ম না পরেই যুদ্ধ করেন। তারা ছিলেন মৃত্যুভয়হীন, বেপরোয়া ও শাহাদাতপিপাসু। এদেরকে বলা হতো নেকেড ওয়ারিয়র। দেরার (রা.)ছিলেন এদেরই একজন। রোমান সম্রাট তাঁকে জীবন্ত বন্দী করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। রোমান বাহিনীর সৈন্যরা অনেক কষ্ট করে যুদ্ধের একটা পর্যায়ে দেরারকে ঘিরে ফেলে এবং তাঁকে বন্দী করতে সক্ষম হয়। ঐ ময়দানেরই অন্য অংশে যুদ্ধ করছিলেন তাঁরই বোন খাওলা (রা.)। ভাইয়ের বন্দী হওয়ার সংবাদ যখন খাওলার (রা.) কানে গেল তিনি কালবিলম্ব না করে একটি প্রশিক্ষিত ঘোড়ায় চড়ে হাতে বল্লম আর খোলা তলোয়ার নিয়ে ছুটে যান অকুস্থলে। গিয়ে তিনি বহুসংখ্যক রোমান সৈন্যকে পরাভূত করে ভাইকে উদ্ধার করে আনেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ লড়াই দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেন মহাবীর খালেদ (রা.)। তিনি খাওলাকে (রা.) ডাকেন এবং তাঁর বীরত্বের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন। 
এই ছিল মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নারীর জায়গা। আর আজকে মসজিদে পর্যন্ত নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। তাদেরকে আবৃত করে রাখা হয়েছে কালো কাপড়ে। তাদের সামনে দিবানিশি কেবল তাদের একটা চুলও যদি দেখা হয় তাহলে কী ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে সেই বিবরণ শোনানো হয়। যার পরিণাম এই হয়েছে যে, জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠী অবলায় পরিণত হয়েছে। তারা জাতিরক্ষায় ভূমিকা রাখা তো দূরের কথা, সামান্য বখাটে ছোকড়াদের হাত থেকে নিজেদের ইজ্জতটাও রক্ষা করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। মুসলিম নারী তো এমন ছিল না। কে তাদেরকে এমন জড়বুদ্ধি-অথর্ব বানালো, জাতির বোঝায় পরিণত করল?
আজকে ইসলামের নামে যে সব নারী নিগ্রহকারী ফতোয়ার জাল বিস্তার করা হচ্ছে সেসব দেখে যুক্তিশীল শিক্ষিত মানুষ ভাবছে যে ধর্মগুলোই হলো নারী প্রগতির অন্তরায়। তারা রসুলাল্লাহর (সা.) সৃষ্ট নারীদের ইতিহাস দেখতে রাজি নয়, দেখার দরকারও তাদের নেই। কারণ তারা বর্তমানে নারীদের আপাদমস্তক কালো বোরকা আর মুফতিদের চাপিয়ে দেওয়া পরহেজগার রমণীর কর্তব্যগুলো দেখেই ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের উপাদানগুলো পেয়ে যাচ্ছে। যারা ইসলামের প্রাথমিক যুগের নারীদের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন না, তারা অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে ইসলামবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছেন। এই হচ্ছে ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজির নেট ফল। কারো জানাজায় একজন নারী অংশ নিলে সমাজের ক্ষতিটা কী সে প্রশ্নটি কেউ করছে না, বরং ধরেই নিয়েছে যে নারীদের জন্য ইসলামের বিধানই হলো অপমানজনক কালো বোরখা দিয়ে আবৃত করে রাখা। কে তাদেরকে বলে দেবে যে, রসুলের যুগের নারীরা এমন কি তাঁর স্ত্রীরাও যে কোনো নারী বা পুরুষের জানাজায় অংশ নিতেন? ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে ইসলামবিদ্বেষীদের জবাব দেওয়ার কাজটি ছিল আলেম ওলামাদের। কিন্তু সেটি না করে তারা শত শত বছর ধরে, এমন কি আজকের দিনটি পর্যন্ত বেগানা নারীকে দেখলে কী ভয়াবহ গজব জাতির উপর নেমে আসবে সেই ওয়াজেই ব্যস্ত। ফলে আধুনিক নারীরাও ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। তাই যারাই ইসলামকে ভালোবাসেন তাদের সবার দায়িত্ব এখন ইসলামের প্রকৃত রূপটি তুলে ধরা এবং হাজার বছরের ফতোয়ার নিচে চাপা পড়ে থাকা অনাবিল সত্য ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরা। এমনটি করা আগেই সম্ভব হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকীর মতো মানুষ এমন অজাচিত পরিবেশ সৃষ্টির বা পরিবেশের মুখোমুখি হতেন না।
[বি:দ্র: বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকীর ব্যক্তিগত সমালোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রসঙ্গটা নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরাই উদ্দেশ্য] 
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]