
সাজিদুর রহমান, কুবি:
ভিন্ন তিনটি নাম, তিনটি আলাদা ভাবনা, কিন্তু একটাই গন্তব্য—বইমেলা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থী এবার ‘শহিদ আব্দুল কাইয়ুম স্মৃতি বইমেলায়’ নিজেদের বই প্রকাশ করে তরুণ লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তারা হলেন—লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ও ‘নরকে জান্নাত’ উপন্যাসের লেখক তাজুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ও ‘প্রত্যাগমন’ বইয়ের লেখক সাদিয়া আফরোজ শশী এবং অর্থনীতি বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী ও 'জীবন বড় কল্পনাময়' বইয়ের লেখক ইয়াছিন আরাফাত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় যে সাহিত্যপ্রেমের বীজ রোপিত হয়েছিল, আজ তা ফুটে উঠেছে মলাটবন্দি বইয়ে। কীভাবে গড়ে উঠল তাদের লেখালেখির পথচলা? কেমন ছিল বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা? চলুন, জেনে নেওয়া যাক সেই গল্প।
সাহিত্য শুধু বিনোদন নয়, এটি বাস্তবতার প্রতিবিম্ব। তাজুল ইসলামের ‘নরকে জান্নাত’ তেমনই একটি উপন্যাস, যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের উপর যৌন নির্যাতনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। কৃষক, নেশাখোর, সাধু, এমনকি ধর্মীয় নেতারাও এই শৃঙ্খলে জড়িত। বাস্তব ঘটনাগুলোর ভিত্তিতে উপন্যাসটি রচিত হলেও, কল্পনার আবরণ দিয়ে চরিত্রগুলোকে অপরিচিত রাখা হয়েছে, যেন পাঠক এগুলোকে বাস্তবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে পারেন।
এই উপন্যাস লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের নারীদের উপর যৌন নির্যাতনের গোপন ব্যথা ও কালো অধ্যায় প্রকাশ করা। তিনি বলেন, “আমাদের গ্রামগুলোতে এখনো নারীদের অজস্র জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। কৃষকের স্ত্রী থেকে শুরু করে তথাকথিত সাধু কিংবা ধর্মীয় নেতার শিকারে পরিণত হয় অসংখ্য নারী। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ অনেক সময় সত্য বুঝতে পারে না, ধর্মের নামে প্রতারণার শিকার হয়।”
তাজুল ইসলাম লেখক হওয়ার আগে ছিলেন নিবিষ্ট পাঠক। তার বাবার হোটেল ছিল ধরলা নদীর পাড়ে, যেখানে বিভিন্ন সংবাদপত্র পাওয়া যেত। সেখান থেকেই সাহিত্য পড়ার নেশা শুরু। পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো সংগ্রহ করতেন, মুখস্থ করতেন। একদিন মনে হলো, আমিও লিখতে পারি। ১২-১৩ বছর বয়সে ‘মাসিক মহিলা কণ্ঠ’ পত্রিকায় ‘জাগো’ কবিতাটি পাঠাই। আশ্চর্যের বিষয়, পরের মাসেই তা প্রকাশিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকেই আমি কলম ধরার সাহস পাই।”
এখন পর্যন্ত তার সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে: ‘শ্রেষ্ঠের সন্ধানে’, ‘জারজ সন্তান’, ‘দেহ পুড়ে অন্তর জ্বলে’, ‘ধর্ম বেঁচে ইমান কিনি’, ‘ভাসে ভেলায় বেহুলার লক্ষ্মীন্দর’, ‘পুড়ে যাচ্ছে পৌরাণিক বিহঙ্গ’ এবং ‘নরকে জান্নাত’। এছাড়া আরও কয়েকটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
সাহিত্য কখনো কেবল শব্দের খেলা নয়, এটি একজন লেখকের চিন্তা, অনুভূতি ও পরিশ্রমের প্রতিচিত্র। সাদিয়া আফরোজ শশী যখন তার প্রথম একক গ্রন্থ ‘প্রত্যাগমন’ প্রকাশ করেন, তখন সেটি শুধু তার নিজের গল্প ছিল না—বরং হয়ে উঠেছিল প্রতিটি স্বপ্ন দেখা তরুণ লেখকের অনুপ্রেরণা।
এই বইয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশংসা ও বন্ধুদের উৎসাহ পেয়ে শশী সাহস পেলেন বই হিসেবে প্রকাশ করার। আজ যখন পাঠকদের ভালোবাসায় ‘প্রত্যাগমন’ প্রশংসিত হচ্ছে, তখন তার অনুভূতি একদিকে বিস্ময়ের, অন্যদিকে আনন্দের।
লেখালেখির প্রতি শশীর টান ছোটবেলা থেকেই। চতুর্থ শ্রেণিতে লেখা ‘মশা’ নামে একটি কবিতা দিয়ে তার সাহিত্যিক যাত্রা শুরু। তারপর থেকেই কল্পনার জগতে বিচরণ শুরু হয়, যা সময়ের সঙ্গে পরিণত হয় লেখালেখির অভ্যাসে। “হাইস্কুলে ওঠার পর বিভিন্ন ছোটখাটো ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করি। হিসেব করলে প্রায় ১৫ বছর ধরে লেখালেখির সঙ্গে আছি।”
‘প্রত্যাগমন’ তার প্রথম একক গ্রন্থ হলেও, এর আগে ‘শিশিরের শব্দ’ নামে যৌথ কাব্যগ্রন্থে কবিতা লিখেছেন এবং ‘কাক, কলা ও কবিতা’ ম্যাগাজিনে তার ইংরেজি ছোটগল্প ‘Life is Beautiful’ প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে শশী জানান, “ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই, তবে লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান। আগামী বছরের মধ্যে আরেকটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।”
ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় কবিতা পড়েই কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন ইয়াছিন আরাফাত। তবে সেই স্বপ্ন পূরণে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া সহজ ছিল না তার। সপ্তম শ্রেণিতে একদিন তার কফিল স্যার সবাইকে নিজের লেখা গল্প অথবা কবিতা ক্লাসে আনার জন্য বলেছিলেন। গল্প লিখতে পারলেও অনেক চেষ্টা করেও কবিতা লিখতে ব্যর্থ হন ইয়াছিন। সেই ব্যর্থতাই তার মনে জেদ তৈরি করে, যা তাকে কবিতা লেখার পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন, “সেই সময় থেকে প্রতিদিন কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। সপ্তম শ্রেণিতেই প্রথম কবিতা লিখি, যার নাম ছিল ‘তুমি আছো তাই’। এরপর আর থেমে থাকিনি।”
‘জীবন বড় কল্পনাময়’ কাব্যগ্রন্থটি তার দুই শতাধিক কবিতা থেকে বাছাই করা ৪৫টি সেরা কবিতা নিয়ে গঠিত। এখানে ইসলামিক, সামাজিক ও রোমান্টিক এই তিন ধরনের কবিতা স্থান পেয়েছে।
লেখালেখির পেছনে ইয়াছিন আরাফাত সবচেয়ে বেশি অবদান স্বীকার করেন তার তিন বোনের, যাদের উৎসাহ তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন তার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন এবং 'অনন্য প্রকাশন' ও সম্পাদক কাজল রায়কে, যারা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তার ভাষ্য, “আমি এতদূর আসতে পেরে সৃষ্টিকর্তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। আমার পরিবার এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, যাদের সমর্থন আমাকে আজ এখানে পৌঁছে দিয়েছে।”
ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ছিল তার নেশা। বইয়ের পাতায় অন্য কবিদের কবিতা পড়ে বেড়ে ওঠা ইয়াছিন আরাফাত এখন নিজেই একজন কবি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন বড় কল্পনাময়’ এর পর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘পলাতক জীবন’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার অনেক কবিতা ও গল্প ছাপা হয়েছে। ‘জীবন বড় কল্পনাময়’ শুধু কবিতার একটি সংকলন নয়, বরং এটি তার জীবনের স্বপ্নপূরণের একটি মাইলফলক।