Date: May 01, 2025

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সাহিত্য / ধর্ম প্রচারে অর্থের লেনদেন নিষিদ্ধ - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

ধর্ম প্রচারে অর্থের লেনদেন নিষিদ্ধ

April 19, 2024 09:49:46 AM   রিয়াদুল হাসান
ধর্ম প্রচারে অর্থের লেনদেন নিষিদ্ধ

রিয়াদুল হাসান:
হেদায়াতের জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিশেষ দান। পবিত্র কোর’আন হচ্ছে মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াহ বা পথনির্দেশ (সুরা বাকারা ২)। তাই কোর’আন শিক্ষা দিয়ে তথা দীন শিক্ষা দিয়ে তার কোনো বিনিময় মানুষ নিতে পারে না। কোর’আনের জ্ঞান মানুষের নিজস্ব জ্ঞান বা সম্পত্তি নয় যে একে পণ্যরূপে বিক্রি করা যাবে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, “পূর্ববর্তী কেতাবে লিপিবদ্ধ আছে, আল্লাহ বলেছেন, “হে আদমের সন্তান! পারিতোষিক গ্রহণ ব্যতীত শিক্ষা দান কর, যেরূপভাবে তোমাদের পিতা পারিতোষিক দেওয়া ছাড়া শিক্ষালাভ করেছে।” (ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে কুদসি।)

কোনো নবী-রসুল ইসলাম প্রচার করে তার বিনিময় গ্রহণ করেন নি। তারা বলেছেন, হে আমার সম্প্রদায়! এর (হেদায়াতের আহ্বান) পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট (সুরা হুদ-২৯)। ইসলামের চিরন্তন এই নীতি শেষ নবী (সা.) ও তাঁর উম্মাহর জন্যও বলবৎ রেখেছেন। তাঁর হুকুম স্পষ্ট, তোমরা তুচ্ছমূল্যে আমার আয়াত বিক্রি করো না এবং আমার শাস্তি থেকে বাঁচো (সুরা বাকারা ৪১)। তিনি আরো বলেন, যারা আল্লাহর নাজিলকৃত আয়াত গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব মূল্য গ্রহণ করে তারা আগুন ছাড়া কিছুই খায় না। তাদের শাস্তি জাহান্নাম (সুরা বাকরা ১৭৪)।

তথাপি পবিত্র কোর’আন শিক্ষা দিয়ে, কোর’আনের তাফসির করে, কোর’আন খতম দিয়ে, খতম তারাবি পড়ে ইত্যাদি নানা উপায়ে অর্থ উপার্জন করে চলেছে এক শ্রেণির আলেম। প্রকৃতপক্ষে দীনের যে কোনো কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ গোষ্ঠীটি সাধারণ মুসলমানকে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য নসিহত করে কিন্তু নিজেরা নামাজ পড়িয়ে, দোয়া করে, মিলাদ পড়িয়ে, জানাজা পড়িয়ে, খোতবা দিয়ে, ওয়াজ করে, কোর’আন শিক্ষা দিয়ে, বিয়ে পড়িয়ে, মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য চাঁদা তুলে অর্থাৎ ইসলামের বিবিধ আনুষ্ঠানিক কাজ করে অর্থ গ্রহণ করে। এক শ্রেণির আলেমের পেশাই দীনবিক্রি। এর বাইরে অনেক পীর সাহেব আছেন, তারাও মুরিদদেরকে আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলের তরিকা শিক্ষা দিয়ে তার বিনিময়ে হাদিয়া, নজর-নেওয়াজ নিয়েই দিন গুজরান করছেন। এই গোষ্ঠী সকল ধর্মেই ছিল এবং আছে। আল্লাহ তাদের বিষয়ে আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে, “অধিকাংশ পণ্ডিত ও সংসারবিরাগী (পীর) মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। তারা যে সোনা রূপা সঞ্চয় করে, হাশরের দিন সেগুলো উত্তপ্ত করে তাদের ললাটে ও পার্শ্বদেশে ছ্যাঁকা দেওয়া হবে” (সুরা তওবা ৩৪)। এই শ্রেণির আলেম ও পীরদেরকে ধর্মব্যবসায়ী হিসাবে সাব্যস্ত করা যুক্তিসংগত।

কোর’আনের বিনিময় গ্রহণ সম্পর্কে রসুলাল্লাহর (সা.) সিদ্ধান্ত:
১. ওবাদাহ বিন সামিত (রা.) একজন ব্যক্তিকে কোর’আন শিক্ষা দিলে লোকটি খুশি হয়ে তাঁকে একটি ধনুক উপহার দেন আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার জন্য। ওবাদাহ (রা.) দ্বিধান্বিত চিত্তে উপহার গ্রহণ করলেন। কিন্তু মনের সন্দেহ গেল না। তাই তিনি রসুলাল্লাহর দরবারে এসে আরজ করলেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি কি এই ধনুকটি গ্রহণ করতে পারি? আমি তো এটা দিয়ে যুদ্ধের মাঠে তীর ছুঁড়ব।” রসুলাল্লাহ বললেন, “যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষাদানের উপর একটি ধনুকও গ্রহণ করবে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার পরিবর্তে জাহান্নামের আগুনের ধনুক তার গলায় লটকাবেন। তুমি যদি গলায় জাহান্নামের শিকল পরতে ভালোবাস, তাহলে তা গ্রহণ করো।” (ইবনে মাজাহ, বায়হাকি)

২. বিশিষ্ট সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে শিবল (রা.) বলেন, আমি রসুলাল্লাহকে বলতে শুনেছি যে, তোমরা কোর’আন তেলাওয়াত করো তবে তাতে বাড়াবাড়ি কোরো না এবং তার প্রতি বিরূপ হয়ো না। কোর’আনের বিনিময় ভক্ষণ কোরো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা কোরো না।’ - হাদিস: মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৪০; কিতাবুত তারাবীহ।

৩. রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে কেউ কোর’আন পড়ে সে যেন তা দিয়ে আল্লাহর কাছে চায়। এরপর এমন কিছু মানুষ আসবে যারা কোর’আন পড়ে তার বিনিময় মানুষের কাছে চাইবে। - হাদিস: তিরমিযি/২৯১৭

৪. অর্থের বিনিময়ে কোর’আন খতমের যে ধারা আমাদের সমাজে চালু হয়েছে সে বিষয়ে রসুলাল্লাহর একটি ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, একদিন আমরা একদল লোক এক স্থানে সমবেত ছিলাম। আমাদের মধ্যে আরব, অনারব, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ সকল শ্রেণির লোকই ছিল। এ অবস্থায় নবী করিম (সা.) আমাদের মধ্যে আগমন করে বললেন, ‘তোমরা সৌভাগ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছ। তোমরা আল্লাহর কেতাব তেলাওয়াত করে থাক। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রসুল বর্তমান রয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে মানুষের নিকট এইরূপ এক যুগ আসবে যখন তীরের ফলক বা দণ্ড যেরূপ সরল ও সোজা করা হয়, লোকেরা কোর’আন তেলাওয়াতকে ঠিক সেইরূপ সরল ও সোজা করবে। তারা দ্রুত তেলাওয়াত করে নিজেদের পারিশ্রমিক আদায় করবে এবং এর জন্য তাদের বিলম্ব সহ্য হবে না। (আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে আহমদ)।

৫. আব্দাল্লাহ ইবনে মা’কাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমজানে লোকদের নিয়ে তারাবি পড়ালেন। এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাঁর কাছে এক জোড়া কাপড় এবং ৫০০ দিরহাম পাঠালেন। তখন তিনি কাপড় জোড়া এবং দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন, আমরা কোর’আনের বিনিময় গ্রহণ করি না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৩৭, হাদিস: ৭৮২১)।

আল্লাহ ও রসুলের (সা.) এ সকল কঠোর হুঁশিয়ারী সাহাবিদের মনে-মগজে ও চরিত্রে এই কথা প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল যে, দীনের বিনিময় নেওয়া হারাম। তাঁরা তাই কখনোই কোর’আন পাঠ বা শিক্ষাদানের বিনিময় গ্রহণ করতেন না, একে আগুনের মতো ভয় করতেন। তারা সবসময় আশঙ্কায় থাকতেন, কোনোভাবে ইসলামের কাজের বিনিময়ে সম্পদ গ্রহণ করে ফেলেন কিনা। তারা ইসলামের যাবতীয় কাজ করতেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। পার্থিব জীবনযাপনের চাহিদা মেটাতে তারা হালাল পথে পরিশ্রম করে রোজগার করতেন। যতদিন তাঁরা ধরাধামে অবস্থান করেছেন, ততদিন এ জাতির মধ্যে ধর্মজীবী কোনো গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়নি। অথচ বর্তমানে ধর্মজীবীদের হাতেই ইসলাম কুক্ষিগত।

এই অবস্থাটা একদিনে হয়নি। আল্লাহ বলেছেন, দীন সহজ সরল, সিরাতুল মুস্তাকীম। রসুলের (সা.) যুগে কোর’আন বোঝার জন্য কোনো পণ্ডিত হওয়ার দরকার ছিল না। নিরক্ষর সাহাবিরাও মানুষকে কোর’আন শিক্ষা দিতে পারতেন। তাদের সামনে একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, সেটা হচ্ছে সংগ্রাম করে পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান প্রতিষ্ঠা করা। তাদের হাতে কোর’আনের কোনো লিখিত কপিও ছিল না। কিন্তু পরবর্তী যুগে দীন প্রতিষ্ঠার এই উদ্দেশ্য, আকিদা, লক্ষ্য তাদের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। রসুলাল্লাহর ওফাতের একশ বছর পর জেহাদ পরিত্যাগ করা হলো। উম্মতে মোহাম্মদী ছিল একটি সামরিক জাতির মত, তাদের সকল কর্মব্যস্ততা ছিল জেহাদকেন্দ্রিক। যখন উমাইয়া, আব্বাসীয় সুলতানরা জেহাদ ছেড়ে দিলেন তখন জাতির কর্মব্যস্ততা ও কর্মশক্তি ভিন্ন দিকে মোড় নিল। ঐতিহাসিকদের মতে কোর’আনের সঙ্গে যেন রসুলাল্লাহর কথা যেন মিশে যেতে না পারে সেজন্য তিনি তাঁর হাদিস সংগ্রহ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “কোর’আন ছাড়া আমার কাছ থেকে তোমরা আর কিছুই লিখবে না। যে এরকম যা কিছু লিখেছ, মুছে ফেল। তখন কিছু সাহাবি কর্তৃক কোর’আন-হাদিস মিলিয়ে যা কিছু লেখা হয়েছিলো, সব পুড়িয়ে ফেলা হয় (মুসনাদে ইমাম আহমদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১৭১, মজমায়ুজ জাওয়ায়িদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১৫২)। তাই রসুলাল্লাহর বাণী ও কার্যাবলী কেবল সাহাবিদের স্মৃতিতেই রক্ষিত ছিল। সাহাবিদের ইন্তেকালের ফলে হাদিস বিলুপ্ত হওয়ার আশংকায় হিজরি ৯৯ সনে উমর বিন আব্দুল আজিজ (র.) হাদিস সংকলনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি মদিনার শাসনকর্তা আবু বকর বিন মুহাম্মাদ বিন হাযম- এর প্রতি এ মর্মে ফরমান জারী করেন- 
‘রসুল (সা.) এর কথা, তাঁর সুন্নাত অথবা ওমর (রা.)-এর বাণী কিংবা অনুরূপ যা কিছু পাওয়া যায়, তার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্য লিখে নাও। কেননা আমি ইলমে হাদিসের ধারকদের অন্তর্ধান ও হাদিস সম্পদ বিলুপ্তির আশংকা করছি’। (বঙ্গানুবাদ সহিহ আল-বুখারি, তাওহীদ ট্রাস্ট বাংলাদেশ, ১৯৯৮ খ্রি., ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৫)। এই নির্দেশের ফলে আবু বকর বিন হাযম বিপুল পরিমাণ হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন করেন। পরবর্তীতে এরই ভিত্তিতে সর্বত্র হাদিসের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে।

অপর একজন শাসনকর্তার নামে নিম্নোক্ত ভাষায় একটি নির্দেশনামা প্রেরণ করেন:
“হাদিসবিদ ও বিদ্বান লোকদেরকে আদেশ করুন! তাঁরা যেন মসজিদে মসজিদে হাদিসের শিক্ষাদান ও তার ব্যাপক প্রচার করেন। কারণ হাদীছের ইলম প্রায় বিলীন হওয়ার উপক্রম হচ্ছে’। (হাদিস সংকলনের ইতিহাস, মাওলানা আব্দুর রহীম, পৃঃ ৪০৩)।

এই আদেশ জারির পর মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য অঞ্চলে হাদিস সংকলনের কাজ শুরু হয়। কথিত আছে যে, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে শিহাব আল-জুহরি সর্বপ্রথম হাদীস সংগ্রহ এবং সংকলনে হাত দেন। লক্ষ লক্ষ হাদিস জমে ওঠে যার অধিকাংশই জাল ও দুর্বল হাদিস। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় ছয় লক্ষ হাদিস থেকে দ্বিরুক্তি বাদ দিলে মাত্র ২,২৩০ টি হাদিসকে ইমাম বোখারী তাঁর নিজ হাদিস সংকলন গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন, দ্বিরুক্তিসহ ৭২০০ হাদিস। এই লক্ষ লক্ষ হাদিস থেকে শুরু হল মাসলা মাসায়েল আবিষ্কার করার কাজ। এ গবেষণায় যারা নামলেন তাদের নাম মুজতাহিদ। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে শুরু হল মতবিরোধ। একটি পাত্রে কুকুর খাবার খেয়েছে। পাত্রটি পবিত্র করতে কী করণীয়- এমন সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে শুরু হল চুলচেরা বিশ্লেষণ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ফিকাহ শাস্ত্র প্রণয়নে মন দিলেন পণ্ডিতগণ। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে সৃষ্টি হল মতবিরোধ, পরিণামে জাতি প্রধানত চার মাজহাবে আর অগণিত ফেরকায় বিভক্ত হয়ে গেল। ফিকাহ্ রচনার সঠিক তরিকা (উসুলে ফিকাহ) অনুশীলনের জন্যে প্রয়োজন বিরাট জ্ঞান ভাণ্ডারের। এ পন্থায় শরয়ী বিধান সম্পর্কে রায় কায়েম করার জন্যে ব্যক্তির ভাণ্ডারে হাদিসের বিরাট সঞ্চয় বর্তমান থাকা আবশ্যক। হাম্বলি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফিকাহ গ্রন্থ অটোমান যুগের মিশরীয় ফকিহ মারি ইবনে ইউসুফ আল-কারমি কর্তৃক লিখিত “গায়াতুল মুনতাহা ফি গাম আল-ইকনা ওয়াল মুনতাহা”-তে উল্লেখকৃত একটি ঘটনা এখানে প্রাসঙ্গিক। একদা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘এক লাখ হাদিস জানা থাকা মুফতি হবার জন্যে যথেষ্ট নয় কি?’ তিনি বললেন, ‘নয়’। অতপর প্রশ্নকর্তা হাদীসের সংখ্যা বাড়াতে থাকে আর তিনি ‘নয়’ বলতে থাকেন। অবশেষে প্রশ্নকর্তা বললেন, ‘পাঁচ লাখ হাদিস জানা থাকলে?’ এবার তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আশা করা যেতে পারে।’ (গায়াত আল মুনতাহা)। যখন এই পরিস্থিতি দাঁড়ালো যে, একজন মুফতিকে অন্তত ৫ লক্ষ হাদিস জানতে হবে, তখনই সমাজে একটি পৃথক ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অপরিহার্যতা দেখা দিল। দীন যদি সরল থাকতো তাহলে আর এদের দরকারই হত না।

এখন এহেন মুফতিরা আদালতগুলোতে চাকুরি লাভ করলেন। তখন ইসলামের বিধান দিয়ে আইন-আদালত চলত, তাই মুফতি, কাজি, হাকিমদের ফিকাহ শাস্ত্রের প্রয়োজন পড়ত, কেননা তাতে বিভিন্ন বিধি-বিধান বিষয়বস্তু অনুসারে বিন্যাস করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন মাজহাবের ফিকাহ আবার আলাদা। এ পর্যায়ে এসে অর্থের কাছে দীন পরাজিত হতে শুরু করে। মুসলিম বিশ্বের শাসকশ্রেণি ততদিনে নানা প্রকার ইসলাম পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা জেহাদ ছেড়ে, জাতির উদ্দেশ্য ভুলে বিশ্বের অপরাপর রাজা-বাদশাহদের মত ভোগবিলাসে মগ্ন হয়ে যায়। ইসলামপূর্ব আরবে যেসব জাহেলিয়াতি রেওয়াজ প্রচলিত ছিল, সেগুলোই আবার প্রচলিত হয়ে গেল। অশ্লীল নৃত্যগীত, মদ্যপান খুব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হল। জাতির শাসক হিসাবে দীনের যে কাজগুলো তাদের উপর ন্যাস্ত ছিল যেমন সালাতের ইমামতি করা, খোতবা প্রদান করা, সেগুলোতে গাফেলতি চলে আসলো। তারা বেতন দিয়ে ইমাম, খতিব নিয়োগ দিলেন। নিজেরা শরিয়তের জ্ঞান অর্জন না করে আলেম ভাড়া করতে শুরু করলেন। এই আলেমরা চাকরি বাঁচাতে সব সময় সুলতান, শাহজাদা, আমির, উজির, নাজিরদের যাবতীয় কুকর্মকে জায়েজ করে যেতে লাগলেন। এর জন্য আল্লাহর দীন, রসুলের শিক্ষাকে তারা বিকৃত করতে কসুর করলেন না। একটি উদাহরণ দিই।

ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সংস্কারক, মুহাদ্দিস, লেখক, ধর্মতত্ত্ববিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর ‘মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বনের  উপায়’ গ্রন্থে লিখেছেন, মিশরের প্রসিদ্ধ ফকিহ ইমাম সিরাজ উদ্দিন বুলকীনীর ছাত্র আবু যুর বলেন, “একবার আমি আমার উস্তাদ ইমাম বুলকীনীকে জিজ্ঞেস করলাম: শাইখ তকীউদ্দীন সবকী ইজতিহাদের রাজপথে চলেন না কেন, তাঁর মধ্যে তো ইজতিহাদের সমুদয় শর্তাবলী বর্তমান? তিনি কী কারণে তাকলীদ (মাজহাবের অন্ধ অনুসরণ) করেন? আবু যুর বলেন, আমি লজ্জায় তাঁর (বুলকীনীর) নাম আর উল্লেখ করলাম না। অথচ তাঁর সম্পর্কেও আমার একই প্রশ্ন! আমার প্রশ্ন শুনে তিনি চুপ থাকেন। অতপর আমি নিজেই জবাব দিতে লাগলাম: আমার মতে, সেই সরকারী চাকুরি চলে যাবার ভয়ে তিনি এমনটি করছেন, যা চার মাযহাবের ফকিহদের জন্যে নির্ধারিত রয়েছে। কারণ, যে ব্যক্তি চার মাযহাব থেকে খারিজ হয়ে স্বাধীনভাবে ইজতিহাদ করবেন, তার সরকারি চাকরি হবে না। বিচারপতির পদ তার জন্যে হারাম হয়ে যাবে। লোকেরা তার কাছে ফতোয়া চাইতে আসবে না এবং তাকে বিদআতী বলে আখ্যায়িত করবে। আমার বক্তব্য শুনে তিনি মুচকি হাসলেন এবং তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করলেন।”
এভাবেই জাতির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে স্বার্থন্বেষী আলেম শ্রেণি যারা দীন শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া নীতি ও রসুলাল্লাহর (সা.) নির্দেশ লংঘন করতে থাকে। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষণ করার জন্য বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দেন সুলতানগণ। ধর্মজীবী গোষ্ঠীর এই আল্লাহর হুকুম পরিপন্থী কাজ দেখে জাতির মধ্যে বিরাজিত সত্যনিষ্ঠ আলেম ও সলফে সালেহিনগণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।

বিনিময় গ্রহণ সম্পর্কে তাবেয়ীন ও সলফে সালেহীনদের সিদ্ধান্ত:
১. প্রসিদ্ধ তাবেয়ী যাযান (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি কোর’আন পড়ে মানুষ থেকে এর বিনিময় গ্রহণ করে, সে যখন হাশরের মাঠে উঠবে তখন তার চেহারায় কোনো গোশত থাকবে না, শুধু হাড্ডি থাকবে। - মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস: ৭৮২৪

২. বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা শাদিদ আদ্দিন হুজায়ফা মিরআশি (রহ.) (মৃত্যু ২০৭ হিজরি) বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যদি দুটি স্বভাব না থাকত!’ ইবনে আবি দারদা প্রশ্ন করলেন, ‘সে দুটো কী কী?’ তিনি বললেন, ‘সুখের সময় যদি আমরা আল্লাহর অবাধ্য না হতাম! আর আমরা নিজেদের আমল দিয়ে যদি দুনিয়া কামাই না করতাম!” (হিলইয়াতুল আওলিয়া: ৩/৪৮২, আখবারুস সালাফ- আবু ইয়াহিয়া জাকারিয়া)

৩. সুফি সাধক বিশর বিন হারিস (রহ.) (১১০ হি. - ২২৭ হি.) বলেন, আমি ফুজাইল ইবনে ইয়াজকে বলতে শুনেছি, “দীন বেচে দুনিয়া ভোগ করার চাইতে আমার কাছে ঢোল-তবলা-বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দুনিয়া ভোগ করা অধিক পছন্দনীয়।” (শুআবুল ঈমান: ৫/৩৫৭, আখবারুস সালাফ- আবু ইয়াহিয়া জাকারিয়া)।

৪. সাইদ বিন আমর (রহ.) বলেন, ‘হাসান বসরি যখন হাদিসের আলোচনায় বসতেন, তখন মানুষ তার জন্য হাদিয়া আনত। কিন্তু তিনি হাদিয়া ফিরিয়ে দিয়ে বলতেন, “যে ব্যক্তি এ মসনদে বসে কিছু গ্রহণ করে, তার জন্য আল্লাহর কাছে কোনো অংশ থাকবে না।” (ইমাম আহমদ কৃত আজ-জুহদ: ২৪৫, আখবারুস সালাফ-আবু ইয়াহিয়া জাকারিয়া)।

৫. মুহাম্মদ বিন ইউসুফ ইসফাহানি (রহ.) সব সময় এক দোকানদারের কাছ থেকে তরকারি কিনতেন না। তিনি বলতেন, ‘সব সময় একজনের কাছ থেকে তরকারি কিনতে গেলে তারা আমাকে চিনে ফেলবে; ফলে আমাকে সুবিধা বেশি দেবে। আর আমি নিজের দীন বেচে জীবন যাপন করতে চাই না। (হিলইয়াতুল আওলিয়া: ১৪/১১৪, আখবারুস সালাফ- আবু ইয়াহিয়া জাকারিয়া)

৬. আব্দুল্লাহ বিন মুহাইরিজ এক দোকানে এলেন। উদ্দেশ্য, কাপড় কিনবেন। দোকানদারকে এক লোক তখন বলল, ‘ইনি ইবনে মুহাইরিজ। তার সাথে সুন্দর করে কেনা-বেচা করবে।’ তখন ইবনে মুহাইরিজ রেগে গিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেলেন আর বললেন, ‘আমরা আমাদের পয়সা দিয়ে পণ্য কিনি, দীন বেচে নয়।’ (সিফাতুস সাফওয়া, আখবারুস সালাফ- আবু ইয়াহিয়া জাকারিয়া)।

সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে কোর’আন, হাদিস তথা দীন শিক্ষা দিয়ে বিনিময় গ্রহণ ইসলামের প্রাথমিক যুগে একটি গর্হিত অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হত, যা আজকে রীতিমত সওয়াবের কাজ হিসাবে পরিচিত। এই বিকৃত প্রথা আজ আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে ও সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার উদ্ভাস ঘটাতে হলে ধর্মব্যবসার ক্ষতিকর দিকসমূহ এবং এ বিষয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষের কাছে তুলে ধরা অপরিহার্য।

[লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট]