Date: May 02, 2024

দৈনিক দেশেরপত্র

collapse
...
Home / সাহিত্য / ‘আরবীয় পোশাক’ মানেই কি ইসলামি পোশাক? - দৈনিক দেশেরপত্র - মানবতার কল্যাণে সত্যের প্রকাশ

‘আরবীয় পোশাক’ মানেই কি ইসলামি পোশাক?

April 19, 2024 10:14:39 AM   রিয়াদুল হাসান
‘আরবীয় পোশাক’ মানেই কি ইসলামি পোশাক?

আল্লাহর শেষ নবী রসুল (সা.) আরবে এসেছেন, তিনি আরবের মানুষ, তাঁর আসহাবগণও আরবের মানুষ। আমাদের দেশের একজন নেতা বাংলাতে কথা বলবেন, বাংলাদেশের পোশাক পরবেন এটাই স্বাভাবিক। তেমনি রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা আরবীয় পোশাক পরেছেন, আরবিতে কথা বলেছেন, আরবীয় খানা-খাদ্য খেয়েছেন। এর দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না, সারা দুনিয়ার মানুষকেই ঐভাবে আরবিতে কথা বলতে হবে, আরবীয় জোব্বা, পাগড়ি পরিধান করতেই হবে। কারণ যারা তাঁদের বিরোধিতাকারী তারাও একই পোশাক পরেছে, একই প্রকার খাদ্য খেয়েছে।

সুতরাং আমরা বুঝলাম, ‘আরবীয় সংস্কৃতি’ মানেই ‘ইসলামী সংস্কৃতি’ নয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী পুরুষদের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক। এখন কেউ যদি প্যান্ট পরে বা ধুতি পরে তাহলেও কিন্তু তার সতর আবৃত হয়। কিন্তু প্যান্ট বা ধুতি পরাকে কি আলেমরা ইসলামী সংস্কৃতি বলে মেনে নেবেন? না, তারা একে খ্রিষ্টানি বা হিন্দুয়ানী পোশাক বলে অপছন্দের চোখে দেখবেন। তারা চান মানুষকে তেমন জোব্বা পরাতে যেটা আরবের লোকেরা পরে থাকেন। তারা ভুলে যান যে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আরবের সকল মানুষই ঐ জাতীয় পোশাকই পরে থাকেন, কারণ সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে ঐ পোশাক সঙ্গতিশীল। কিন্তু আমাদের দেশের জেলে-চাষী যারা লুঙ্গি কাছা দিয়ে মাছ ধরেন, চাষ করেন, তারা কী করবেন? আরবীয় জোব্বা পরে কি এই কাজগুলো করা যাবে? মনে রাখতে হবে খাদ্যাভ্যাস, পোষাক, ভাষা ইত্যাদি হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কোনো অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং এটা ভৌগোলিক আবহাওয়ার কারণে স্বতস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে। এখন কেউ যদি স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আরবদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করে নেয় তাহলে সেটা তার সংস্কৃতিতে পরিণত হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো সমস্যাও নাই। সমস্যা হচ্ছে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ায়। মূলত জোর করা ততটুকু যুক্তিসঙ্গত যতটুকু আল্লাহ শরিয়তে বাধ্য (ফরজ) করেছেন।

এটা অপ্রাকৃতিক বলেই মহান আল্লাহ নারী ও পুরুষ উভয়কেই পোশাকের ব্যাপারে বলেছেন, দৃষ্টিকে অবনত কর, লজ্জাস্থানকে হেফাজত করো। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘মুমিনদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।’ (সুরা নুর ৩০)। এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা পুরুষদের দৃষ্টি অবনত রাখার আদেশ দিয়েছেন। পরের আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে; তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে, তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।’ (সুরা নুর ৩১)।

এখন লজ্জাস্থান (আওরাহ) কোনটা, কতটুকু ঢেকে রাখা পুরুষের জন্য ফরজ তা শরিয়াহ বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। যেমন হানাফি মাজহাবের ফিকাহ শাস্ত্রের প্রধান গ্রন্থ আল-হিদায়াহ অনুসারে পুরুষের সতর হল নাভীর নিচ থেকে হাঁটু পর্যন্ত। কেননা রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, পুরুষের সতর হল নাভী থেকে হাঁটুর মধ্যবর্তী অংশ। অন্য বর্ণনায় আছে, রসুল (সা.) বলেছেন, নাভীর নিচ থেকে তার হাঁটু অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত (আবু দাউদ : ৪৯৭)।  এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নাভি সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইমাম শাফেয়ী ভিন্নমত পোষণ করেন। (আল-হিদায়াহ, ১ম খণ্ড, সালাতের পূর্ববর্তী শর্তসমূহ অধ্যায়)।

উইকিপিডিয়াতে প্রদত্ত ওংষধসরপ পষড়ঃযরহম নামক প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে, “সুন্নী ইসলামের প্রচলিত মতানুসারে পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক হচ্ছে তাদের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা, যদিও তাদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ আছে যে, পুরুষদের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক, নাকি শুধু দুই উরুর মধ্যবর্তী অঙ্গ (যৌনাঙ্গ)।”

ইমাম আহমদ বলেন, “একজন পুরুষের আওরাহ (লজ্জাস্থান) হল নাভি ও হাঁটুর মধ্যবর্তী স্থান। তবে নাভি নিজেই এবং প্রতিটি হাঁটু আওরাহ নয়। উরু আওরাহ। সালাতের সময় ও সালাত ছাড়া অন্যান্য সময়ের জন্য এই একই নিয়ম।” (আল মুগনি-ইবনে কাদামা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫৭৭, ৫৭৮। মাকতাবা আল জুমহুরিয়া আল আরাবিয়া, কায়রো, মিশর। আল ফিকহ আল ইসলাম ওয়া আদিলাতিহি, খণ্ড ১ পৃষ্ঠা ৭৪৫-৭৫৩, মাকতাবা রাশেদিয়া কোয়েটা পাকিস্তান)। সুতরাং উলঙ্গ না থাকলেই ফরজ আদায় হয়ে গেল। কাছা দিয়ে মাছ ধরা, চাষাবাদ করা বা গাছে ওঠায় শরিয়াহগত কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এরপরে পোশাক নিয়ে আর বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।

তবে পোশাক কেবল লজ্জাস্থান আবৃত করার জন্যই নয়, পোশাক মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, মর্যাদা প্রকাশ করে। তাই আল্লাহ বলেন, ‘হে বনী-আদম আমি তোমাদের জন্যে পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার বস্ত্র এবং তাকওয়ার পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।’ (সুরা আরাফ ২৬)।

ইসলাম সর্বোত্তম আদর্শ, মুসলিম জাতি একটি সভ্য জাতি। কাজেই তাদের সামাজিক অনুষ্ঠান, সালাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পোশাকে, ভাষায়, শিল্প-সংস্কৃতিতে সৌন্দর্যবোধ থাকতেই হবে। পাশাপাশি থাকতে হবে তাকওয়া, আল্লাহ প্রদত্ত মানদণ্ডের প্রতি আনুগত্য। ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোনো স্থান নেই। তাই সাদামাটা, বেরঙিন পোশাক পরে দরবেশি ও দুনিয়াবিমুখতা প্রকাশ করার কোনো মাহাত্ম্য ইসলামে নেই। আল্লাহ পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন, আল্লাহর সাজসজ্জাকে (জিনাত), যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহ কে হারাম করেছে? আপনি বলুনঃ এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মো’মেনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বুঝে। (সুরা আরাফ ৩২)।

পোশাক নির্ভর করে মূলত পেশা, পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর। কাজের পোশাক পরে যেমন কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে যায় না তেমনি সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে আরবীয় জোব্বা পরিয়ে দেওয়াও ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। সতর ঢাকার পর তার চেয়ে অধিক আপনি যেমন খুশি পোশাক পরতে পারেন। কী পোশাক দিয়ে আপনি সতর ঢাকবেন বা কী ধরনের পোশাক পরে নিজেকে সভ্য সমাজে উপস্থাপন করবেন, সেটা একান্তই আপনার অভিরুচি। আপনি চাইলে দেশীয় সংস্কৃতি অনুসরণ করতে পারেন, চাইলে আরবের সংস্কৃতিও অনুসরণ করতে পারেন। আরবের সংস্কৃতির পোশাকের সঙ্গে সওয়াব বা গোনাহের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।

আর নারীদের সতর হচ্ছে মুখমণ্ডল, হাত, পায়ের পাতা ছাড়া সারা শরীর। পবিত্র কোর’আনে সুরা নূরের ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুস্পষ্টভাষায় বলেছেন যে, তারা (মো’মেন নারীরা) যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে। বর্তমানে আপাদমস্তক ঢেকে রাখার বিধানটা পরহেজগারীর নিদর্শনস্বরূপ করা হয়ে থাকে কিন্তু সাধারণ প্রকাশমান অঙ্গগুলো খোলা রাখাই আল্লাহর নির্দেশ। এই অঙ্গ কোনগুলো সেটা নিয়ে প্রসিদ্ধ ফেকাহ গ্রন্থ হেদায়াহ-তে বলা হচ্ছে যে, মুখমণ্ডল এবং কব্জি পর্যন্ত উভয় হাত খোলা রাখার যৌক্তিক কারণ হলো এই যে, পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদের লেনদেন তথা দেওয়া নেওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। কাজেই মুখমণ্ডল ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত খোলা রাখারও বিশেষ জরুরত রয়েছে। [আল হেদায়াহ (৪র্থ খণ্ড), পৃষ্ঠা ১৬৯ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)]।

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদিস থেকেও এই কথার সমর্থন মেলে। তিনি বলেন, একদিন আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় রসুলাল্লাহর (সা.) নিকট গেলেন। তিনি তখন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন: হে আসমা! মেয়েরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তার শরীরের কোনো অঙ্গ দৃষ্ট হওয়া উচিত নয়, তবে কেবলমাত্র এটা এবং এটা ব্যতীত। এ বলে তিনি তাঁর মুখমণ্ডল এবং তাঁর দু’ হাতের তালুর দিকে ইঙ্গিত করলেন (আবু দাঊদ ৪১০১)।

এই হল ইসলাম মোতাবেক নারীর পোশাকরীতি। এই মানদণ্ড মেনে নারী যে কোনো পোশাক পরিধান করতে পারে, তাকে আরবীয় পোশাক পরতেই হবে, বাঙালি ঐতিহ্যের পোশাক পরা যাবে না- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ইসলাম আরোপ করে না। আবার কেউ যদি আরবদের পোশাক রীতি অনুসরণ করে সেটা তার রুচি, এতেও দোষের কিছু নাই। তবে কেউ আরবীয় পোশাক পরে এটা দাবি করতে পারে না, যে সে অধিক মুত্তাকি, বা অধিক ফজিলতের হকদার।