
সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, কুরআন কি বলে? -এই বিষয়ের উপর গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (১৭ মে) সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে কুরআন পাঠ আন্দোলন।
দি ইকরা এর প্রতিষ্ঠাতা সাদিক মোহাম্মদ আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কুরআন পাঠ আন্দোলনের আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মাজাহার।
ফরহাদ মাজহার বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ এর অভ্যুত্থান একটি উপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলন কে ঘটিয়েছে, কে মাস্টারমাইন্ড এসব খুব তুচ্ছ তর্ক। কোনো ব্যক্তি এই অভ্যুত্থান ঘটায়নি।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আপনারাই ৮ আগস্ট ভুল করেছেন হাসিনার সংবিধান মেনে শপথ নিয়ে। ইতিহাস না পড়ায় আপনারা তখন সেই সংবিধান বাতিল করার দাবি করেননি। রক্তের ঐক্য এখন যেকোনোভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
গণঅভ্যুত্থান করা হয়েছে জনগণের ক্ষমতা কায়েম করতে -এমন মন্তব্য করে এই চিন্তাবিদ বলেন, গণঅভ্যুত্থান একটি সামাজিক ও রুহানি শক্তি। ৫ আগস্ট বাংলাদেশ নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে হাজির হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের লড়াইটা পশ্চিমের বিরুদ্ধে। আমাদের পশ্চিমকে জয় করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলকে যখন উপনিবেশিক করা হলো, তখন থেকে আমাদের ধর্ম, ইতিহাস, কালচার সম্পর্কে তাদের বয়ান বা ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে। সেসব জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পড়ানো হয়। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা গোলামে পরিণত হয়েছি। কারণ ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জানি না।’
তরুণ সমাজকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যতদিন এই তরুণরা বুঝতে না পারবে ততদিন তারা বোতল ছুঁড়ে মারবে, ঝগড়া করবে।
দৈনিক দেশেরপত্রের সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী বলেন, কোরআন একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কোরআনের আদেশ-নিষেধকে বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
রুফায়দাহ পন্নী আরো বলেন, আমরা গণতন্ত্র দেখেছি, সমাজতন্ত্র দেখেছি, স্বৈরতন্ত্রও দেখেছি। কোনো ব্যবস্থাই আমাদেরকে শান্তি দিতে পারেনি। অথচ রসুলাল্লাহ (সা. ) এর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে একটি জীবনব্যবস্থা দিয়েছেন, যে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পনেরশ’ বছর আগে জাহেলিয়াতে পূর্ণ আরব সমাজের আমূল পরিবর্তন হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই ঐশী বিধান প্রতিষ্ঠা করলে আজকেও একই ফলাফল পাওয়া যাবে। সূতরাং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কোরআনের আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
রূফায়দাহ পন্নী বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যখন বিভিন্ন মহল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিভিন্ন সংস্কারের প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন আমরাও সরকারের কাছে এ সংস্ক্রান্ত প্রস্তাবনা তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, আল্লাহর দেয়া বিধানের আলোকে যদি আমাদের কাঠামোগুলোতে সংস্কার আনা হয়, তবেই কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিন বলেন, আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো প্রকৃতপক্ষে একটি ভঙ্গুর কাঠামো। তবুও আমাদের চেষ্টা করতে হয়, কারণ এই দেশে নানান ধর্ম-বর্ণ-জাতির মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে। তাদের সঙ্গে ন্যায়ভিত্তিক সম্পর্ক ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে একটি দায়িত্বশীল, মানবিক ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।
তিনি আরো বলেন, আমরা যদি সংবিধান রচনায় কোরআন, বাইবেল কিংবা অন্য কোনো মহান আসমানী কিতাবের ন্যায়ের দিকগুলো গ্রহণ করতে পারি, তবে সেটা কেবল ধর্মীয় কারণে নয়, বরং মানবিক মর্যাদা, ন্যায়ের শাসন ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যা বাহ্যিক শক্তির বদলে অভ্যন্তরীণ সততা ও মানবিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে।
সামান্থা শারমিন বলেন, আমাদের সংবিধানে ন্যায়বিচার, নিষ্ঠা ও মানবিক মর্যাদাকে কীভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটার দিকেই নজর দেওয়া উচিত। আমাদের উচিত কোরআন ও ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা এবং মানুষকে সেই অনুযায়ী যোগ্য করে তোলা Ñযাতে তারা আইন, বিচার ও রাষ্ট্র নিয়ে যুক্তিসম্মত মন্তব্য করতে পারে।
এই রাষ্ট্র একটি ভঙ্গুর কাঠামো -এটা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু তবুও আমরা চেষ্টা করে যাই, কারণ আমাদের মধ্যে নানান ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। তাদের একসাথে বসবাস নিশ্চিত করতে একটি কার্যকর রাষ্ট্র কাঠামোর প্রয়োজন। তবে সেই কাঠামোকে শুধু শক্তিশালী নয়, বরং দায়িত্বশীল হতে হবে।
কুরআন পাঠ আন্দোলনের উদ্যোগে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী, প্রাবন্ধিক গবেষক ও ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থনৈতিক সমন্বয়ক দিদারুল ভূইয়া, বিইউপি’র সহযোগী অধ্যাপক মেজর (অব:) আলমগীর হোসন।