বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রভাবশালী তিনটি রাজনৈতিক দল—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে অভিযোগ তুলেছে যে, সরকারের কিছু উপদেষ্টা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন না। প্রশাসনে বদলি-পদায়নসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে নির্বাচনপূর্ব সময়ের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করছে দলগুলো।
বিএনপির অভিযোগ সবচেয়ে স্পষ্ট। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সরাসরি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলে। বিএনপির দাবি, প্রশাসন ও পুলিশের পদায়নে জামায়াতে ইসলামীর স্বার্থে কাজ করছেন কিছু উপদেষ্টা। তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে নামসহ একটি তালিকাও জমা দিয়েছেন। বিএনপির চোখে সবচেয়ে বিতর্কিত উপদেষ্টা হচ্ছেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, যিনি প্রশাসন রদবদলের কেবিনেট কমিটিতে রয়েছেন। একই কমিটির সদস্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শেখ আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছে তারা। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীর বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি আরও অভিযোগ করেছে, ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের সঙ্গে যুক্ত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন করেছে যেন বিতর্কিতদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বিএনপির বৈঠকের পরদিনই জামায়াতে ইসলামী নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। তাদের অভিযোগও মূলত প্রশাসনে বদলি ও পদায়ন ঘিরে। তবে জামায়াত সরাসরি কোনো নাম প্রকাশ করেনি। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, তারা সরকারকে সতর্ক করেছেন, প্রয়োজনে পরে নাম প্রকাশ করবেন। তবুও দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজনের প্রতি তাদের আপত্তি রয়েছে। সালেহউদ্দিন আহমেদ জনপ্রশাসন বিষয়ক কেবিনেট কমিটির নেতৃত্বে আছেন, যা প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়।
এদিকে এনসিপি-ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বড় দলগুলো—বিএনপি ও জামায়াত—প্রশাসনে ভাগ-বাঁটোয়ারা করছে, আর সেই প্রক্রিয়ায় উপদেষ্টা পরিষদের কিছু সদস্য সহায়তা দিচ্ছেন। এনসিপির ভিন্ন উদ্বেগ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো নিয়ে। তারা জানতে চেয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আলোচনার মধ্যে বর্তমান সরকারের গঠন বা নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না। তবে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি চাইছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে কাজ করুক—অর্থাৎ সরকার যেন নীতিগত সিদ্ধান্ত না নেয় এবং শুধু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এখন সরকারের একমাত্র অগ্রাধিকার হওয়া উচিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি তত্ত্বাবধায়ক শব্দটি ব্যবহার না করলেও নিরপেক্ষতার ওপর জোর দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, তিনটি দলই এখন প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী। তাই তারা পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের রাজনীতি চালাচ্ছে। তার মতে, দলগুলো এই অভিযোগের মাধ্যমে সরকার ও প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, সব দলের মতামত বিবেচনায় নিয়ে সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে।
সব মিলিয়ে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিএনপি মনে করে জামায়াত ঘনিষ্ঠ কিছু উপদেষ্টা প্রশাসনে প্রভাব খাটাচ্ছেন, জামায়াত বলছে বিএনপি-ই প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করছে, আর এনসিপির অভিযোগ—উভয় বড় দলই নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার করতে চাইছে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাস এখন সরকারের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা—দুটিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।